অসমাপ্ত আত্মজীবনী | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | পাঠ প্রতিক্রিয়া: আবু বকর সাইম
অবতারণা:
আত্মজীবনী বলতে সাধারণত যা বুঝায়, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিকে ঠিক একই ছাঁচে ফেলা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বইয়ে তাঁর নিজের চেয়ে চারপাশের মানুষ ও দেশের কথাই বেশি বলেছেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি সম্পর্কিত তথ্যাদি:
বই: অসমাপ্ত আত্মজীবনী
লেখক: শেখ মুজিবুর রহমান
জনরা: আত্মজীবনী
প্রকাশনী: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
প্রকাশক: মহিউদ্দিন আহমেদ
সম্পাদক: শামসুজ্জামান খান
প্রচ্ছদকার: সমর মজুমদার
ভূমিকা: লেখকের জ্যেষ্ঠ কন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রথম প্রকাশ: জুন, ২০১২
পৃষ্ঠা: ৩২৯ (মূল আত্মজীবনী ২৮৮ পৃষ্ঠা)
মূল্য: ২২০ টাকা মাত্র (সুলভ সংস্করণ)
⏩ রকমারি লিংক ⏩
⏩ আরও পড়ুন: রামগোলাম : হরিজন সম্প্রদায়ের এক অনবদ্য উপাখ্যান!
পাঠ পর্যালোচনা:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ১৯৬৭ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে তিনি এটি লেখা শুরু করেছিলেন। তবে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক করে তাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে গেলে সঙ্গতভাবেই তিনি আর লেখার সুযোগ পাননি।
বইয়ের প্রথমদিকের বর্ণনায় বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু মূলত তাঁর সহধর্মিণী, সহকর্মী এবং গুণগ্রাহীদের আগ্রহের কারণেই আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন।
অধিকাংশ আত্মজীবনীই সাধারণত লেখকের নিজের ব্যক্তিগত গুনগান বা মাহাত্ম্য দিয়ে শুরু হলেও এই বইয়ের লেখক খুব সচেতনভাবেই এই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। যা বইটিতে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। তবে এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য একটি দিক ছিল— হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিভিন্ন সময়ের বর্ণনা এবং বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনে তাঁর প্রভাব।
বইয়ের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁর পারিবারিক ইতিহাস ও শৈশব, কৈশোরের বর্ণনা করেছেন। এখানে উঠে এসেছে এক গ্রামীণ কিশোরের দুরন্ত জীবন, খেলাধুলা, এমনকি হঠাৎ শুরু হয়ে যাওয়া মারপিটের কথাও।
এই দুরন্তপনার মধ্যেও লক্ষণীয়, বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন আপোষহীন। অন্যায়, অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করা তাঁর স্বভাবে ছিল না।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি একদিকে যেমন— আত্মজীবনী, অন্যদিকে— সমানতালে রাজনৈতিক দলিলও। নিজের জীবনীর মধ্য দিয়ে লেখক একটি নির্দিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন বেশ স্বচ্ছতার সাথে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৫ সালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের সাবলীল বর্ণনা রয়েছে।
⏩ আরও পড়ুন: পুতুলনাচের ইতিকথা : বই রিভিউ!
১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী স্কুল পরিদর্শনে গেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে উনাদের সাক্ষাৎ হয়, সেই সূত্রে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে পত্র যোগাযোগ, পরবর্তীতে তিনি সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন এবং ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গেলে সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন। কলকাতা থেকে ফিরে এসে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন এবং তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৪১ সালের পর বঙ্গবন্ধু পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর থেকে পরবর্তী প্রতিটি ন্যায্য দাবিতেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন সম্পৃক্ত, যা এই বইয়ে উঠে এসেছে। প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামেই বঙ্গবন্ধু অন্যান্য নেতাদের সাথে হাত মিলিয়ে লড়ে গেছেন।
দেশবিভাগের পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন স্বাধীনতার যে স্বপ্ন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ দেখেছিল তা অধরাই থেকে যাচ্ছে! দেশ বিভাগের পর থেকেই শুরু হয় মুসলিম লীগের আদর্শিক বিপর্যয়। এসময় তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, কথা বলেছেন নিপীড়িত মানুষের পক্ষে।
১৯৪৮ সালে শুরু হয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আদায়ের আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে এ গ্রন্থে।
সেসময় মুসলিম লীগের প্রতি জনগণের অনাস্থা বেড়ে যাওয়ায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় পুরোনো লীগ কর্মী ও অন্যান্য নেতাকর্মী নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে জয়েন্ট সেক্রেটারি করা হয়।
এছাড়াও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন, ছাত্র রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো, কয়েক জায়গায় ভ্রমণের বর্ণনা, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কথা উঠে আসে এই বইয়ে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনার সময়ই থেমে যায় লেখকের আত্মজীবনী লেখা। ঠিক এই কারণেই বইটির নামও যথার্থতা পায়।
নিজস্ব মূল্যায়ন:
বঙ্গবন্ধু বাগ্মিতায় যেমন ছিলেন অসাধারণ, লেখার ক্ষেত্রেও তাই! এই বইয়ের প্রতিটি বর্ণনা এত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে যে চোখের সামনে ভাবতে খুব বেগ পেতে হয়নি। প্রচলিত ভাষার প্রাঞ্জল ব্যবহার বইটিকে স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে। বাড়তি বর্ণনা দেখা যায়নি লেখাতে। তবে অনেক বেশি চরিত্রের অবতারণা ও নামের ব্যবহার নিয়ে পাঠককে বেগ পেতে হবে বইয়ের বিভিন্ন অংশে।
⏩ আরও পড়ুন: কালান্তর | আবুল হাসনাত বাঁধন
ব্যক্তিগত রেটিং ও পাঠ-পরামর্শ:
সার্বিক বিবেচনায় বইটি ৪.৫/৫ রেটিং পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তবে বইটি পাঠের ক্ষেত্রে পাঠককে অনেক বেশি সচেতন ও মনযোগী থাকতে হবে পুরোটা সময় ধরে।
*********
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির বিস্তারিত পাঠ প্রতিক্রিয়া! বইটি সম্পর্কে জেনে ভালো লাগলে পড়ে দেখতে পারেন। বই পড়ুন, বইয়ের সাথে থাকুন, আলোকিত মানুষ হোন। আজকের পোস্টটি এ পর্যন্তই। লেখাটি ভালো লাগলে পরিচিত বইপড়ুয়া বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। বই সম্পর্কিত আপনার কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা থাকলে কমেন্টে জানান। এই ধরনের পোস্ট আরও পড়তে চাইলে ডেইলি লাইভ সাইটে চোখ রাখুন। ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর একটা রিভিউ পড়লাম।