আমাদের আশেপাশে দেখতে পাওয়া ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য ফল হলো কলা। কেবল আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই কলার জনপ্রিয়তা ব্যাপক। এটি সহজলভ্য বলেই যে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে তা কিন্তু নয়। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু, ঠিক তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর। কলার সুঘ্রাণ এবং আকর্ষণীয় রংও এর জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ। তো, ডেইলি লাইভের আজকের এই পোস্টে আমরা আলোচনা করব— কলা কী, কলার ব্যবহার, কলার পুষ্টি উপাদান এবং কলার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত। চলুন শুরু করা যাক।
কলার নানাবিধ উপকারিতা ও অপকারিতা
কলা:
কলা বা Banana হলো বেরি জাতীয় একটি সুমিষ্ট ফল। এটি দেখতে হলুদ, লাল, সবুজ বিভিন্ন রঙয়ের হয়। তবে, কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাকা অবস্থায় হলুদ এমন কলাই বেশি পরিচিত। কলা মূলত মিউজেসি (Musaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মিউজা (Musa) গণের একটি একবীজপত্রী উদ্ভিদের ফল। কলার সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি প্রজাতি ( Species) হলো-
১। Musa sapientum: বাজারে বীজবিহীন যেসব কলা পাকা অবস্থায় খাওয়া যায় তা মূলত এই প্রজাতির কলা। আর এই প্রজাতির কলার গাছ তুলনামূলক দীর্ঘকার হয়।
২। Musa cavendishi: পাকা অবস্থায় খাওয়ার উপযোগী যেসব কলার গাছ বামন আকৃতির, সেসব কলা এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।
৩। Musa paradisiaca: যেসব কলা রান্না করে খাওয়া হয় তা এই প্রজাতির। আবার, এই প্রজাতির কলাগুলো হাইব্রিড বা সংকর হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৯ টি কলার জাত রয়েছে। সারা বিশ্বে কলার প্রায় একশো প্রজাতির কলা রয়েছে। কলা সাধারণত উষ্ণ জলবায়ুতে ভালো জন্মায়। তবে এটি এখন সারা বছরই যেকোনো মাটিতে চাষ করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, কলার আদি বাসস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বিশেষ করে চীন ও ভারতবর্ষে। তবে, অনেকের মতে পাক-ভারত ও মালয়ই কলার আদি উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে সারা বিশ্বেই কলা ব্যাপক হারে চাষ করা হয়। বাংলাদেশও তার বিপরীত নয়। বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই কলা চাষ হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সাধারণত বুনো কলা, বাংলা কলা, মামা কলাসহ নানা বুনো প্রজাতির চাষ করা হয়। জনপ্রিয় কিছু কলার নাম উল্লেখ করা হলো-
বীজহীন কলা– সবরি, সাগর, দুধসর, দুধ সাগর, কগ্নিশ্বর, ইত্যাদি।
সল্প বীজের কলা– চম্পা, চিনি, জাবকাঁঠালি, কবরি, চিনি চম্পা, ইত্যাদি।
বীজময় কলা– এঁটে কলা, বতুর, আইটা, গোমা, ইত্যাদি।
কাঁচাকলা বা রান্নার কলা– আনাজি কলা, ভেড়ার ভোগ, চোয়াল পউশ, বর ভাগনে, বেহুলা, মন্দিরা, বিয়ের বাতি, ইত্যাদি।
কলার পুষ্টি উপাদান:
কলাকে এর সুমিষ্ট স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য ফলের রানি বলা হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কলা প্রধান ফল। সারা বিশ্বব্যাপী কলার পুষ্টিগুণ বহুল পরিচিত। শক্তির অন্যতম উৎস এই কলা। কারণ কলায় উপস্থিত রয়েছে- আমিষ, জল, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ (পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ইত্যাদি), বিভিন্ন ভিটামিন (ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ইত্যাদি), আঁশ, ফ্যাট বা চর্বি, শর্করা, ইত্যাদি। ১০০ গ্রামের একটি কলায় উপস্থিত থাকে ১১৬ গ্রাম ক্যালরি। এইজন্য ডাক্তাররা দুধ ও ডিমের পর, কলা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কলার ব্যবহার:
পাকা কলা ফল হিসাবে খাওয়া হয় এবং কাঁচা কলা রান্না করে খাওয়া এটা সবাই কমবেশি জানি। মূলত, কলার ওপরের হলুদ খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের অংশটুকু খাওয়া হয়। তবে, কাঁচা কলার ক্ষেত্রে ভেতরের অংশ তো খাওয়াই হয়। অনেক অঞ্চল কাঁচা কলার খোসাও খাওয়া হয়। এগুলো দিয়ে ভর্তা, কোফতা, চপ, ইত্যাদি তৈরি করা হয়। আর কাঁচা কলার ভেতরের অংশ দিয়ে দেশ-বিদেশে নানা পদের রান্না হয়। বাংলাদেশে মাছ দিয়ে কারি, চপ, ভর্তা, ইত্যাদি বেশি জনপ্রিয়। আর রোগীর পথ্য হিসাবে কাঁচা কলার জনপ্রিয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে, পাকা কলাও কম যায় না। ফল হিসাবে তো খাওয়াই যায়, সেইসাথে কলার কেক, পিঠা, ডেজার্ট, আইসক্রিম বেশ জনপ্রিয়। কেবল খাবারে নয়, পাকা কলা ব্যবহৃত হয় ত্বক ও চুলের নানাবিধ রূপচর্চায়।
⏩ আরও পড়ুন: ফুলকপির উপকারিতা ও অপকারিতা!
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ আমরা জানলাম, কলা কী, কলার পুষ্টি উপাদান, কলার নানাবিধ ব্যবহার সম্পর্কে। এই পর্যায়ে আমরা জানব, কলার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে।
কলার উপকারিতা:
কলাকেও এর পুষ্টিগুনের জন্য সুপারফুড আখ্যা দেওয়া হয়। কলা আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। আমাদের শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুস্থতায় কলার ভূমিকা অপরিসীম। তো চলুন জেনে নিই, এই হলুদ রঙয়ের আকর্ষনীয় কলার কিছু অসাধারণ উপকারিতা সম্পর্কে-
১। কলা আমাদের শরীরের তাৎক্ষণিক এনার্জি বা শক্তি যোগায় এবং দুর্বলতা দূর করে। তাই আপনি যদি ক্লান্ত অনুভব করেন, তবে একটা কলা খেয়ে নিতে পারেন। কারণ কলায় রয়েছে প্রচুর ক্যালরি।
২। নিয়মিত কলা খেলে আমাদের কিডনি সুরক্ষিত থাকে। কারণ কলায় উপস্থিত রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম। এই পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম আমাদের কিডনিকে সঠিক ভাবে তার কাজ করতে সহায়তা করে। এছাড়াও পটাসিয়াম লেভেল আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে কিডনিকে সুরক্ষিত রাখে। প্রতিদিন কলা খেলে কিডনিতে পাথর হওয়া, মুত্রনালীর ইনফেকশন, আলসার, মস্তিষ্কের স্ট্রোকসহ নানা সমস্যার ঝুঁকি কমে।
৩। কলা আমাদের ওজন কমাতে যেমন ভূমিকা রাখে, ঠিক তেমনি ওজন বাড়াতেও বেশ ভালো কার্যকরী। ওজন কমানো এবং বৃদ্ধি করাতেও রয়েছে কলার দারূণ উপকারী ভূমিকা। কেন না কলায় রয়েছে রেজিস্ট্যান্স ও পেকটিন যা হজম হতে দেরি হয়। ফলে, দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরা থাকে, ক্ষুধা কম লাগে। তাই ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিন একটি করে কলা খাওয়া উচিত। অপরদিকে, ওজন বাড়াতে চাইলে একটু কম পাকা কলা খাওয়া উচিত; তবে পাকা কলাও বেশ কার্যকর।
৪। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করতেও কলা বেশ কার্যকর। কারণ কলাতে বিদ্যমান রয়েছে উচ্চ মাত্রার ফাইবার, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তবে, অবশ্যই কাঁচা কলা খেতে হবে। এছাড়াও এই কাঁচা কলা পাকিস্থলির আলসার, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও দূর করে।
৫। কাঁচা কলা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। কারণ এই কলায় বিদ্যমান থাকে দুই ধরনের ফাইবার- পেকটিন ও রেজিস্ট্যান্স স্টার্চ। যদিও কলায় এই রেজিস্ট্যান্স স্টার্চের জন্য হজমের ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা হয়ে থাকে। তবে, আশার কথা হলো এই পেকটিন-এর রয়েছে কোলন ক্যানসার প্রতিরোধের ক্ষমতা।
৬। ত্বক ও চুল ভালো রাখতেও কলা ভূমিকা রাখে। কলায় রয়েছে আমাদের চুল, ত্বক ও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইটোকেমিক্যাল, যা আমাদের ত্বক, শরীর এবং চুলকে পুষ্টি প্রদান করে থাকে। কলা আমাদের মুখের ব্রণ দূর করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে, মুখের দাগ ও বলিরেখা দূর করে। এছাড়াও কলাতে উপস্থিত থাকা ম্যাঙ্গানিজ ত্বকের কোলোজেন গঠনে সহায়তা করে এবং ত্বক ও শরীরের অন্যান্য কোষকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেলস হতে সুরক্ষিত রাখে।
৭। কলা আমাদের শরীরের রক্ত স্বল্পতা দূর করতেও বেশ কার্যকর। রক্ত স্বল্পতা মুলত আমাদের শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেলে দেখা যায়। আর কলায় যেহেতু আয়রন থাকে, সেহেতু কলা খেলে এই সমস্যা থেকে রেহাই মেলে।
তাছাড়াও কলা আমাদের তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে, আমাদের মানসিক ও স্ট্রেস কমায়, গর্ভবতী নারীদের বমি বমি ভাব দূর করে। এছাড়াও গর্ভবস্থায় মা নিয়মিত কলা খেলে অনাগত সন্তানের জন্মত্রুটি হ্রাস পায়, অ্যানিমিয়ার ঝুঁকি কমে, স্নায়ুতন্ত্রের সুষ্ঠ বিকাশ ঘটে, হাড়ের বিকাশ ঘটে, ইত্যাদি।
⏩ আরও পড়ুন: ওজন বাড়ানোর সহজ উপায়!
কলার অপকারিতা:
কলার এত এত উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত কলা খেলে বা শারিরীক কিছু সমস্যার মধ্যে তা বিপত্তি বয়ে আনে। চলুন এবার জেনে নিই কলার সেসব বিপত্তি বা অপকারিতা সম্পর্কে-
১। যাদের মাত্রারিক্ত মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে তাদের কলা না খাওয়াই উত্তম। কারণ কলা টাইমারাইন নামক এক ধরনের উপাদান থাকে, যা মাইগ্রেনের ব্যথা তীব্র করে।
২। একটু আগেই জেনেছি কিডনি ভালো রাখে কলা। তবে, যারা ইতোমধ্যে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন। তাদের কলা খাওয়া খুবই অনুচিত।
৩। অতিরিক্ত কলা খেলে হাইপারক্যালেমিয়া হতে পারে। কারণ কলায় রয়েছে উচ্চ মাত্রার পটাশিয়াম। আর পটাশিয়ামই এই রোগের অন্যতম কারণ।
৪। অতিরিক্ত কলা খেলে দাঁতে ক্ষয় হয়। তাই পরিমিত মাত্রায় কলা খাওয়া উচিত।
৫। অতিরিক্ত কলা খেলে আমাদের নার্ভ সিস্টেমের ক্ষতি হতে পারে।
এছাড়াও অতিরিক্ত কলা খেলে বদহজম, ক্লান্তি, গ্যাস সৃষ্টি, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জির সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত কলা খেয়ে পটাশিয়ামের প্রভাবে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। আর কলা সকালে বা রাতে খেতে পারেন। তবে, কখনোই খালি পেটে কলা খাওয়া উচিত নয়।
*****
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— কলার নানাবিধ উপকারিতা ও অপকারিতা! আজকের পোস্ট এই পর্যন্ত। পোস্টটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা থাকলে কমেন্ট করুন। এই ধরনের পোস্ট আরও পড়তে ডেইলি লাইভ সাইটে চোখ রাখুন।
বাসায় প্রতিদিনই কলা আনা হয়।
চেনা কলা সম্পর্ক অনেক কিছু জানলাম।