কালান্তর | আবুল হাসনাত বাঁধন
‘এই ব্যস্ত শহর একদিন রং বদলাবে। বদলে যাবে ধীর পায়ে নেমে আসা হেমন্তের রাতটিও। মেঘহীন নীল আকাশে সাদা-কালো-ধূসর মেঘেদের আনাগোনা হবে। মেঘের ফাঁকে মিটিমিটি জ্বলবে কয়েকটি তারা। এই শহরের নিস্তব্ধ রাতে হঠাৎ ধেয়ে আসবে জোনাকির দল। সাথে থাকবে এক ঝাঁক ঝিঁঝি পোকা। তাদের ডাকে জেগে ওঠবে ঘুমন্ত পাখিরা। একফালি চাঁদ মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলবে। হুতুম পেঁচার ডাকে ভয় পেয়ে নববধূ মাথা লুকোবে স্বামীর বুকে। শহরের বিষাক্ত বায়ুগুলো হঠাৎ নির্মল হয়ে ওঠবে। সেইরাতে আমাদের কারও স্বপ্ন অপূর্ণ থাকবে না। আমার, তোমার, আমাদের সবার স্বপ্নপূরণ হয়ে যাবে। আমরা সকলে নতুন স্বপ্ন খুঁজে বেড়াব একসাথে। সময়ের স্রোতে হাতড়িয়ে কিছুই খুঁজে পাব না।’
কোনো এক হেমন্তের রাতে, শিমুল গাছে নিচে বসে কথাগুলো বলেছিলাম তানিমাকে। সে শুনে বলেছিল, ‘বাস্তবতা এত সহজ না। সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। তোমার কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি গল্প-কবিতায় কাটে, বাস্তবে না!’
হ্যাঁ, তার কথা-ই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের কারও স্বপ্ন পূরণ হয়নি। জোনাকির দল কিংবা এক ঝাঁক ঝিঁঝি পোকা কেউই আসেনি এই শহরে। তবে, এই সেলুকাস শহরটা রং বদলেছে। বদলে গেছে শহরের পুরোনো মানুষগুলোও। যেমন, আমি নিজেই বদলে গিয়েছি। মাঝে মাঝে ভাবি, ‘এই আমি কি সেই আমি?’ উত্তর, ‘অবশ্যই না!’
⏩ আরও পড়ুন: শান্তি কমিটি | আবুল হাসনাত বাঁধন
বহুকাল পরে আজ হঠাৎ তানিমাকে দেখলাম। প্রায় ১২ বছর পর। ১২ বছর, পুরো একটা যুগ পেরিয়ে গিয়েছে আমাদের জীবনে! এই সময়ের ভেতরে তানিমা হয়েছে দুই সন্তানের মা, আর আমি এক সন্তানের বাবা। কী অদ্ভুত জীবন আমাদের! কথা ছিল, একই সন্তানের মা-বাবা হবো আমি আর তানিমা। কিন্তু সময় আমার আর তানিমার কথা রাখেনি। দুজনকে পাঠিয়ে দিয়েছে দু’মেরুতে। যেখান থেকে আর কাছে আসা যায় না।
আমার একমাত্র সন্তান, তাসনিয়া। আমার ছোট্ট মাকে এই বছরই স্কুলে দিয়েছি। বয়স চার বছর। প্লে-তে ভর্তি করিয়েছি। আমার স্ত্রী সাইমা, আজ বাড়িতে ছিল না। গ্রামে গিয়েছিল দরকারি কাজে। তাই মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। নিয়েও গেলাম। কিন্তু কখনো কল্পনাও করিনি স্কুলে গিয়ে দেখা পাব তানিমার। তানিমা আর সাইমার সম্পর্ক বেশ ভালোই। কিন্তু সাইমা হয়তো জানে না তানিমা কে ছিল! আর তানিমাও জানে না যে, সাইমা আমার স্ত্রী। স্কুলে তাসনিয়াকে দেখে, তানিমা জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু! তোমার মা আসেনি?’ আমার মেয়ে উত্তর দিলো, ‘না আন্টি, বাবা আসছে। ওই তো বাবা।’
তানিমা আর আমি কেউ কাউকে ভালোভাবে চিনতে পারিনি প্রথমে। বয়সের ছাপ পড়েছে তানিমার মুখে। বেশ খানিকক্ষণ পরে চিনতে পারলাম। সেও চিনতে পেরেছিল। অবাক হয়ে বলল, ‘জিয়াত, তাসনিয়া তোমার মেয়ে?’ আমি নিচু স্বরে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এখানে?’
‘আমার ছেলে মেয়ে পড়ে এখানে। বড়ো মেয়ে ক্লাস ফোরে আর ছোটো ছেলে তাসনিয়ার ক্লাসে।’ নিঃস্পৃহ ভাবে বলল, তানিমা।
যতক্ষণ ছেলে-মেয়েদের স্কুল ছুটি না হয়, ততক্ষণ একসাথে ছিলাম আমরা। খুব একটা কথা বলিনি। হয়তো তানিমার অনেক অভিমান জমে আছে আমার প্রতি। অভিমানের বাঁধ ভাঙেনি। আমিও ভাঙার চেষ্টা করিনি। অল্প, একটু আধটু কথা হয়েছে। চলে আসার সময় বলেছিলাম, ‘আসছি তানিমা, ভালো থেকো।’ সে নিষ্প্রভ ছিল। কোনো উত্তর দেয়নি।
রং বদলানো ব্যস্ত শহরটাই এখন রাত নেমেছে। সময়টা ঠিকই হেমন্ত কাল। সাইমা চলে এসেছিল বিকেলে। মেয়েকে পড়াচ্ছে এখন। আমার এই রূপবতী, গুণবতী বউটাকে ভালো না বাসার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তাই অনেক ভালোবাসি তাকে। কিন্তু তানিমার জায়গাটা কখনো দিতে পারব না সাইমাকে। এই মুহূর্তে বেলকনিতে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছি। আমাদের ফ্ল্যাটটা ৬ তলায়। বাসার সবাই যার যার কাছে ব্যস্ত। সবাই বলতে, আমার মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান। এই আমরা ৫ জনের পরিবার।
বেলকনি দিয়ে ওপর থেকে পুরো শহরকে দেখা যাচ্ছে। চারপাশে কিলবিল করছে মানুষ। জীবন ছুটে চলেছে আপন গতিতে। তার পেছনে ছুটছে ব্যস্ত মানুষগুলো। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জীবনের অর্থ বুঝে না। আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। চিকন বাঁকা চাঁদ। সাথে অসংখ্য তারার ঝিলিমিলি। চাঁদের ক্ষীণ আলো তানিমার খুব পছন্দের ছিল। অতীতের স্মৃতিগুলো কড়াঘাত করছে মস্তিষ্কের কোটরে। দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসবে তারা।
‘আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। অন্য একটা স্কুল থেকে এসে নতুন ভর্তি হয়েছিল তানিমা। ক্লাসের সব ছেলেদের চোখ থাকত শুধুই তানিমার ওপর। আমার খুব রাগ হতো। ইচ্ছে হতো সবকটারে কষিয়ে চড় লাগাই। অবশ্য তাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। কারণ, তানিমা ছিলই যে এমন। গোলাকার ফর্সা মুখ, কোমর সমান লম্বা রেশমি কালো চুল, টানা টানা মায়াবী চোখ, এসব দেখে সবার মাথা-ই গুলিয়ে যায়। কাকে দোষ দেবো?
স্কুল জীবনটা কোনো মতে কাটিয়ে দিয়েছিলাম ওকে দেখে দেখে। চুপি চুপি দেখতাম ওকে। কেউ না বুঝে মতো। সৌভাগ্যক্রমে দুজনে চান্স পেলাম একই কলেজে। কলেজে উঠে বন্ধুত্ব হলো। একে অপরকে ভালোভাবে চিনলাম। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরও গভীর থেকে গভীরতর হলো। বসন্তের কোনো এক রঙিন সকালে হুট করে বলে ফেললাম মনের কথাটা। আমি ভয় পেয়েছিলাম, ‘ও যদি না বলে? রেগে গিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট করে দেয়!’ তাই কয়েকদিন লুকিয়ে ছিলাম। ওর সাথে দেখাও করিনি। কিন্তু একদিন, আমাকে অবাক করে দিয়ে তানিমা উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ!’ সেদিন মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ এই মুহূর্তে আমিই।
⏩ আরও পড়ুন: দলছুট প্রজাপতি | আবুল হাসনাত বাঁধন
সময় ছুটে চলল আপন গতিতে। আমাদের সম্পর্কটা আরও গভীর, আরও পবিত্র হয়েছিল। কলেজের ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, পার্কের বেঞ্চ, নদীর পাড়, সবকিছু আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী। কলেজের ঝাঁকড়া কদম গাছটার নিচে আজও হয়তো তানিমার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে, শুনতে পাব তানিমার উষ্ণ নিঃশ্বাসের শব্দ। কত সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে একসাথে বসে গল্প করতে করতে তার ইয়াত্তা নেই। সোডিয়ামের হলুদ আলোয় প্রায়ই একে অপরের মুখ দেখতাম। প্রাইভেট পড়ে ফেরার সময় রাত্রিবেলা একসাথে ফুটপাত ধরে হাঁটতাম অনেক্ষণ। দুজনেই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কখনো কোনো হাই-ক্লাস রেস্টুরেন্টে না গেলেও মাঝে মাঝে ফুচকা খেতাম একটা মাঝারি মানের দোকানে।
ইন্টার পরীক্ষা শেষ হলো। দুজনে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম ভবিষ্যতের। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় হেমন্তের আকাশে তারা গুনে গুনে স্বপ্ন আঁকতাম। নানান রংয়ের স্বপ্ন। হঠাৎ স্বপ্নগুলো ধূসর হয়ে গেল। দুজনে ভালোই রেজাল্ট করেছিলাম। কিন্তু আমার এ+ আসলেও তানিমার আসেনি। আমাদের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে এমন সময়ে তানিমার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেললেন এক ব্যবসায়ীর সাথে। তানিমা অনেক বুঝিয়েও বিয়ে বন্ধ করতে পারেনি। সেসময় বাড়িতে মেয়েদের কথা শুনা-ই হতো না।
যেদিন বিয়ের তারিখ পড়ল, সেদিন ছিল আমার বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা। তার আগের দিনই আমাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে যেতে হত। তানিমা অনেক কাঁদলো আমার কাছে এসে। একসাথে পালিয়ে যেতে বলল। ওই লোকের সাথে কিছুতেই থাকতে পারবে না সে। আমি তার চোখের জল মুছে দিলেও, তাকে কথা দিতে পারলাম না। আমি ছিলাম উভয় সংকটে। একদিকে পরিবার আর আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন, অন্যদিকে এতদিনের ভালোবাসা।
আমি ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েছিলাম পরিবারের স্বপ্নের কাছে। মাঝে মাঝে মানুষ সময়ের কাছে এতটাই অসহায় হয়ে যায় যে কিছু করার থাকে না। আমিও ভালোবাসার দায়িত্ব থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। বিয়ের দুদিন আগেই ঢাকা চলে আসি। আসার আগে মোবাইলের সিম ভেঙে কর্ণফুলীর জলে ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আর কখনো যোগাযোগের চেষ্টাও করিনি তানিমার সাথে। হ্যাঁ, আমি স্বপ্ন পূরণ করে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলাম, কিন্তু তা আমার ভালোবাসা আর তানিমাকে হারিয়ে!
পুরোনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ ভারি হয়ে ওঠছে। সাইমার ডাক শুনতে পাচ্ছি, ‘জিয়াত! ভাত খেতে এসো। সবাই বসে আছে। তাড়াতাড়ি আসো।’ আমার চোখের কোনায় জল জমেছে। সবকিছু ঝাপসা দেখছি। ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে হেমন্তের দীর্ঘ রাত। এই শহরে এখন জোনাকির দল আর ঝিঁঝি পোকা নেই। সময়টা অনেক বদলে গেছে। তানিমাকে ছাড়া জীবনটাকে অদ্ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। অপূর্ণ। আকাশে ঠিকই অনেক তারা আছে। শুধু আমি নেই, আগের মতো। আমি এখন বাস করি তানিমাহীন অন্য পৃথিবীতে, হয়তো অন্য কোনো সময়ে কিংবা অন্য কোনো কালে।
গল্প: কালান্তর
লেখক: আবুল হাসনাত বাঁধন
রচনাকাল: ০৪/০৭/২০১৫
স্থান: পাথরঘাটা, চট্টগ্রাম।
প্রথম প্রকাশ: এই ‘কালান্তর’ গল্পটি ‘বিবর্ণ প্রহর’ (২০১৬) যৌথ গল্প সংকলন এ প্রথম প্রকাশিত।
প্রিয় পাঠক, ‘কালান্তর’ – গল্পটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ‘কালান্তর’ গল্পটি আবুল হাসনাত বাঁধন এর লেখা। আবুল হাসনাত বাঁধনের লেখা ‘কালান্তর’ এর মতন আরও নতুন নতুন গল্প পড়তে চাইলে ডেইলি লাইভে যুক্ত থাকুন।
খুবই সুন্দর একটা গল্প।