কিটো ডায়েট মূলত কী?

কিটো ডায়েট মূলত কী?

পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আছে। কেউ চিকন, কেউ মোটা, আবার কেউ খুব দুর্বল, কেউ সু-স্বাস্থের অধিকারী! তবে সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষের সংখ্যা বর্তমানে খুবই কম। ওজন বাড়ানো যতটা সহজ, কমানো ঠিক ততটাই ঝামেলার। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন বয়ে আনে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা রোগ। তখন ওজন কমানোটাই হয়ে ওঠে সমাধান। এছাড়া সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন হীনম্মন্যতা বয়ে আনে। তখন ওজন কমানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। তবে সেসব পদ্ধতিতে দেখা যায়, খাদ্যাভাসের বিশেষ পরিবর্তন ও শরীর চর্চার পরামর্শ। বিশেষ করে শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খেতে হবে, আর বাদ দিতে হবে চর্বি। কিন্তু, এসব মানার পরও অনেকের ওজন কমে না। যাদের এমন অসুবিধা, তাদের জন্যই মূলত কিটো ডায়েট। তো, ডেইলি লাইভের আজকের পোস্টে আমরা আলোচনা করব— কিটো ডায়েট আসলে কী, এর উপকারিতা, কিটো ডায়েট কাদের জন্য প্রযোজ্য ও কাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত। চলুন শুরু করা যাক।

কিটো ডায়েট

কিটো ডায়েট আসলে কী?

আমরা জানি, আমাদের শরীরে শক্তির প্রধান উপাদান হলো গ্লুকোজ। তো, শর্করা জাতীয় খাদ্য খাওয়ার মাধ্যমেই আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ সরবরাহ করে। শরীরের নানা অঙ্গে রক্ত সঞ্চালিত হয়ে এই গ্লুকোজ শক্তি সরবরাহ করে থাকে। এভাবে আমাদের যতটুকু গ্লুকোজ দরকার, তা ব্যবহৃত হয়ে বাকি অংশ আমাদের শরীরে জমা হতে থাকে। আর এই জমা গ্লুকোজই আমাদের ওজন বৃদ্ধি করে।

⏩ আরও পড়ুন: কলার উপকারিতা ও অপকারিতা!

তো, আমরা অনেকেই ভাবি, চর্বি জাতীয় খাদ্যই মূলত ওজন বাড়ানোর জন্য দায়ী। তবে, চর্বি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী হলো এই শর্করা জাতীয় খাদ্য। আর কিটো ডায়েটে মূলত এই শর্করা জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয় এবং জোর দেওয়া হয় চর্বি ও প্রোটিন রয়েছে এমন খাদ্যের ওপর।
যদি শর্করা জাতীয় খাদ্য কম খাওয়া হয়, তাহলে আমাদের শরীর পরিমাণ মতো গ্লুকোজ পায় না। তখন শক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের শরীর চর্বি ব্যবহার করতে শুরু করে। আর যখন শরীর হতে চর্বি বা ফ্যাট ভাঙন শুরু হয়, এর মাধ্যমে তৈরি হয় কিটোন বডিজ। আর তখন এই কিটোন বডিজ গ্লুকোজের পরিবর্তে আমাদের শরীরে শক্তি সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে কিটোসিস। আর এই কিটোসিস থেকেই মূলত নামকরণ করা হয়েছে কিটো ডায়েট বা কিটোজেনিক ডায়েট।

আর যখন আমাদের শরীর শর্করা না পেয়ে শরীর হতে চর্বি ভাঙতে বা কমাতে শুরু করে, তখন আমাদের ওজনও কমে যায়। এই ডায়েট খুব ভালোমতো মেনে চললে মাত্র দুই সপ্তাহেই অনেকটা ওজন কমানো সম্ভব। কিন্তু এর জন্য খাদ্যের বিষয়ে অনেক কড়া নিয়ম পালন করতে হয় আর এর বেশ কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। তাই যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বা ভুগছেন, তাদের এমন ডায়েট না করাই ভালো। যদি ডায়েট করতেই হয় তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করতে পারেন।

কিটো ডায়েটে যেসব খাদ্য পরিহার করতে হয়

১| ভাত — খাদ্য তালিকা হতে এই ডায়েট করতে প্রথমেই বাদ দিতে হবে ভাত। কিন্তু, আমরা বাঙালিরা দুই বেলা ভাত খেতে অভ্যস্ত। আবার অনেকে তো তিনবেলা ভাত খেতেই অভ্যস্ত। ভাত হলো শর্করা জাতীয় খাদ্য। তাই ভাত খেয়ে যতই শাক-সবজি খাওয়া হোক না কেন, অনেকের ওজন কমতে চায় না।

২| রুটি — ভাত বাদ দেওয়ার কথা ওঠলেই তখন বিকল্প হয় রুটি। তবে, চাল, আটা কিংবা ময়দা সবগুলোতে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ থাকে। এইজন্য আদা ও ময়দার তৈরি রুটি, পাস্তা, সিরিয়াল খেলে ওজন কোনো মতেই কমবে না। তাই এই জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।

৩| ফলমূল — যদিও ডায়েটে ফলমূল খাওয়াতে জোর দেওয়া হয়, কিন্তু কিটো ডায়েট ফল-মূল খেতে না করে থাকে। কারণ ফলে রয়েছে প্রচুর গ্লুকোজ। তাই ফল খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে। তবে জাম জাতীয় ফলগুলো অল্প মাত্রায় খাওয়া যাবে।

৪| ডাল বা শস্য জাতীয় খাদ্য — ডাল বা শস্যজাতীয় খাদ্যও পরিহার করতে হবে। যেমন: মটর, মসুর ডাল, মুগ ডাল, বিভিন্ন বীজ, ইত্যাদি।

৫| বিশেষ কিছু সবজি — এক্ষেত্রে কিছু সবজিও পরিহার করতে হবে। যেমন: সকল প্রকার আলু, গাজর ও অন্যান্য টিউবার জাতীয় সবজি।

৬| দুগ্ধজাত খাদ্য — দুধ ও দুধের তৈরি খাবার পরিহার করতে হবে। তবে বাটার, মাখন ও পনির খাওয়া যাবে।

৭| কোমল পানীয় — কোমল পানীয় আমাদের সবারই প্রিয়। এতে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। তাই কোমল পানীয় পান থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়াও অ্যালকোহলে আসক্তি থাকলেও তাও পরিহার করতে হবে।

এখানের অনেক খাবারই আছে, যা আমাদের প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিটো ডায়েটে কম সময় লাগে বলেই, এই ডায়েটের খাদ্য তালিকা এত কড়া। তবে, একদিনে সব খাবার বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়নি, আস্তে আস্তে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে বাদ দিতে পারবেন।

⏩ আরও পড়ুন: ওজন বাড়ানোর সহজ উপায়!

কিটো ডায়েটে যেসব খাবার খাওয়া যাবে

কিটো ডায়েটে অনেক খাবার বাদ দিলেও আবার বেশ কিছু খাবার খাওয়া যাবে, তবে পরিমিত পরিমাণে। যেমন: সকল প্রকার মাছ ও মাংস। বিশেষ করে যেসব মাছে প্রচুর চর্বি বা তেল আছে, তা খাওয়া ভালো। এছাড়াও ঘি, মাখন খাওয়া যাবে। আর কিটো ডায়েটের প্রধান খাদ্য হলো ডিম। এছাড়াও সকল প্রকার বাদাম ও বাদাম থেকে তৈরি অন্যান্য খাদ্য, যেমন- পিনাট বাটার খাওয়া যাবে এবং সয়াবিন তেলের পরিবর্তে অলিভ অয়েল খাওয়া যাবে।সকলপ্রকার সবুজ শাকসবজি, টমেটো, পেয়াজ ইত্যাদি খাওয়া যাবে। আর এই কিটো ডায়েটে মশলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
মূলত ভাত, রুটি আমাদের প্রধান খাদ্য, যার সঙ্গে মাছ-মাংস, ডিম অনুষঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করি। তাই কিটো ডায়েট মেনে চললে, ভাত ও রুটির কথা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেলতে হবে।

কিটো ডায়েটের উপকারিতা

কিটো ডায়েট মেনে চললে ওজন কমার পাশাপাশি আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। এই ডায়েট সঠিক ভাবে মেনে চললে আমাদের শরীরের ক্ষুধা সৃষ্টিকারী হরমোন কম তৈরি হয়, ফলে আমাদের শরীরের ওজন কমতে থাকে। আর কিটো ডায়েট আমাদের ত্বকের জন্যও বেশ উপকারী। যাদের ত্বকে ব্রণ হয়, তারা এই ডায়েট মেনে চললে ব্রণের প্রবণতা একেবারে কমে যেতে পারে।

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসাতে এই ডায়েট পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয় এবং গবেষণায় দেখা যায় যে, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপির পাশাপাশি এই কিটো ডায়েট ক্যান্সারের চিকিৎসায় কাজে আসে। এ ডায়েট অনুসরণে ক্যান্সার কোষ ও টিউমারের বৃদ্ধি কমে আসে। যদিও এই বিষয়ে গবেষণা অনেক সীমিত ও আরও বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। আর যাদের হৃদরোগের সমস্যা আছে তাদেরও এই ডায়েট কাজে আসতে পারে। আমরা জানি, নানা প্রকার হৃদরোগের মূল কারণ হলো আমাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। তো, কিটো ডায়েট আমাদের শরীরের এই ক্ষতিকর কোলেরেস্টরেল কমিয়ে আনতে সাহায্য করে এবং উপকারি কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। তাছাড়াও কিটো ডায়েট বিভিন্ন স্নায়ুরোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়। একটু আগে জেনেছি, কিটো ডায়েট শরীরে কিটোন তৈরি করে। আর এই কিটোন মস্তিষ্কের জন্য অনেক উপকারী। তাই আলঝেইমার ও মৃগী রোগের চিকিৎসাতেও কিটো ডায়েট অনুসরণ করা হয়।

যাদের জন্য কিটো ডায়েট প্রযোজ্য নয়

কিটো ডায়েট অল্প সময়ে ওজন কমানোর জন্য কার্যকরী হলেও, এই ডায়েট দীর্ঘ সময় ধরে মেনে চলা উচিত নয়। কারণ, এই ডায়েট দীর্ঘদিন ধরে মেনে চললে- কিডনিতে পাথর, রক্তে প্রোটিনের আধিক্য, খনিজ ও ভিটামিনের অভাব এবং যকৃতে চর্বি জমতে পারে। এমনকি অনেক দিন ধরে এই ডায়েট ফলো করলে কিটো ফ্লু নামক রোগ হতে পারে। যদিও এই কিটো ফ্লু বেশিদিন থাকে না। তবে, তা যে শরীরে ক্ষতি করে না এমন না। তাই কিটো ডায়েট দীর্ঘ সময় ধরে অনুসরণ না করাই উত্তম।

এছাড়াও যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করতে হয়; যাদের কিডনির রোগ রয়েছে, যাদের ইটিং ডিজঅর্ডার রয়েছে, তাদের জন্যও কিটো ডায়েট প্রযোজ্য নয়। এই ডায়েট শুরুর আগে অবশ্যই চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে।

⏩ আরও পড়ুন: টক দইয়ের উপকারিতা ও অপকারিতা!

সর্বশেষ বলা যায়, বাঙালি বা বাংলাদেশিদের খাদ্য তালিকা ও কিটো ডায়েটের খাদ্য তালিকার মধ্যে বিশাল ফারাক রয়েছে। তাই হুট করে এই ডায়েট অনুসরণ করতে গেলে তা আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। এছাড়াও এই ডায়েট আসলেই স্বাস্থ্যগত কিনা তা নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তাই এই ডায়েট পুরোপুরি অনুসরণ না করে শর্করা জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারেন এবং অতিরিক্ত তেল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। আর সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রাখা ডায়েট চার্ট চিকিৎসকের পরামর্শে তৈরি করতে পারেন। মনে রাখবেন, সবার শরীরের কার্যক্ষমতা এক নয়। আরেক জনের ভালো হয়েছে বলে আপনার ভালো হবে এমন নয়। তাই কোনো কিছু গ্রহণ করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

********* 

প্রিয় পাঠক, এই ছিল— কিটো ডায়েট সম্পর্কে বিস্তারিত! আজকের পোস্ট এই পর্যন্ত। পোস্টটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা থাকলে কমেন্ট করুন। এই ধরনের পোস্ট আরও পড়তে ডেইলি লাইভ সাইটে নিয়মিত চোখ রাখুন।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

1 thought on “কিটো ডায়েট মূলত কী?”

মন্তব্য করুন: