টিকিটাকা : শুরুর গল্প!
টিকিটাকা : শুরুটা হয়েছিল যেভাবে: ১৯৮৮ সাল। সাবেক বার্সেলোনা খেলোয়াড় জোহান ক্রুইফ ফিরে এলেন ক্লাবটির কোচ হয়ে। এই সময়ে ক্লাবের অবস্থা বলতে গেলে খুবই নাজেহাল। কোনো কিছুই বার্সার জন্য ঠিকমতো হচ্ছে না। বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব। ঘরোয়া, ইউরোপীয় সব ট্রফিও যাচ্ছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের ক্যাবিনেটে।
ক্লাবের এমন টালমাটাল অবস্থায় ক্রুইফের কোচ হয়ে ফিরে আসা ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। বলা যায় এই প্রত্যাবর্তন বার্সার ইতিহাসকেই আমূল বদলে দিলো। এমন শক্তভাবে এই বলার অনেকগুলো কারণ আছে। তারই একটা কারণ নিয়ে আজকের এই লেখা।
ক্রুইফ যখন বার্সায় আসলেন তার সাথে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুর সঙ্গে ফুটবলকে বদলে দেওয়া একটা আইডিয়াও আনলেন। নতুন স্টাইলে ফুটবল খেলার একটা আইডিয়া, যার নাম টিকিটাকা। এই টিকিটাকার বরাতেই ক্রুইফের হাত ধরে বার্সা তাদের প্রথম উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতল। টানা চার বছর লিগ টাইটেল জিতল। এবং ক্রুইফের চলে যাওয়ার পরও টিকিটাকা বার্সার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মননে থেকে গেল।
⏩ আরও পড়ুন: ফুটবল বিশ্বকাপের আট মজার ঘটনা!
১৯৭০ এর দশকের শুরুর দিকে নেদারল্যান্ডস আর আয়াক্স টিমের দায়িত্বে ছিলেন কোচ রিনাস মিশেল। আর অধিনায়ক ছিলেন জোহান ক্রুইফ। এই সময়টাতে আয়াক্স একের পর এক শিরোপা জিতে চলছিল। টানা তিনবার ইউরোপের সেরাও আয়াক্সের এই টিম। আর নেদারল্যান্ড দল তো ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ প্রায় জিতেই নিয়েছিল।
এই পুরো ব্যাপারটাই সম্ভব হয়েছিল তাদের একদমই আলাদা একটা প্লেয়িং স্টাইলের কারণে। যাকে বলা হয় টোটাল ফুটবল, এই ধরনের প্লেয়িং স্টাইলে সাধারণত ফুটবলাররা সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সবদিকেই নিজেদের অবস্থান খুব দ্রুত পরিবর্তন করতে থাকে। এবং বলটাকে নেকড়ের পাল যেমন শিকারকে নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে রাখে তেমনিভাবে রাখার চেষ্টা করে। এবং খুব দ্রুত ছোটো-ছোটো পাস দিতে থাকে।
ক্রুইফের বার্সেলোনায় খেলার দিনগুলোতেও তিনি মিশেলসের অধীনে খেলা এই প্লেয়িং স্টাইল মাথায় রাখতেন, মাঝেমধ্যে মাঠে সেটা দেখাতেনও। ১৯৮৮ সালে যখন তিনি ম্যানেজার হিসাবে ফিরে আসলেন, তখন ক্রমশ ভঙ্গুর বার্সেলোনার নতুন কিছু একটার খুব প্রয়োজন ছিল। একটা বিপ্লব, একটা নাড়া দেওয়ার মতো পরিবর্তন। জোহান ক্রুইফ ঠিক সেই কাজটাই করলেন।
অন্যদিকে, ট্যাঙ্গো নামে নৃত্যের একটা বিশেষ মুদ্রা আছে। আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় এই নৃত্য খুব প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। আর সেই নৃত্য থেকেই উদ্ভব ঘটেছিল নতুন একটা ফুটবল প্লেয়িং স্টাইল, সেই একই এলাকায় এই স্টাইল বেড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। এই প্লেয়িং স্টাইলে মূলত মাঠের নিচের অংশ থেকে দুই উইংয়ে বল দেওয়া হতো সুইফট পাসের মাধ্যমে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই পাসিং অ্যাটাকের শুরুটা করত ফুলব্যাকরা, তাই এই সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশও ছিল তারা।
ক্রুইফ বার্সেলোনায় ম্যানেজার হওয়ার পর এবং টিকিটাকা ব্যবহার শুরু করার পরে মোট ফুটবল এবং ট্যাঙ্গোকে একত্রিত করেন। টিকিটাকা ট্যাঙ্গো থেকে সুইফ্ট পাসিং সিস্টেম নিয়েছিল কিন্তু এই স্টাইলে, আক্রমণগুলি পার্কের কেন্দ্র থেকে শুরু হয়েছিল, যা মিডফিল্ডারদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তোলে।
ক্রুইফ বার্সার ম্যানেজার হওয়ার পর টোটাল ফুটবল আর ট্যাঙ্গোর একটা সমন্বয় তৈরি করলেন। তিনি ট্যাঙ্গো থেকে সুইফট পাসিং সিস্টেম আর টোটাল ফুটবল থেকে মিডফিল্ডারদের ব্যবহারটা গ্রহণ করলেন। অর্থাৎ এই সিস্টেমে সুইফট পাসগুলো ফুলব্যাক না বরং মিডফিল্ড থেকে আসবে, যা মিডফিল্ডারদের গুরুত্ব নাড়িয়ে দিলো। আর এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত নতুন প্লেয়িং স্টাইলটাই হলো টিকিটাকা!
⏩ আরও পড়ুন: অ্যাশেজ : শতাব্দী-প্রাচীন এক গৌরবময় সিরিজ!
টিকিটাকায় ফুটবলাররা খুব দ্রুত নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করত আর নিজেদের মধ্যে বল পাস করত। এতই দ্রুত যে প্রতিপক্ষ অনেক সময় তাদের গতিতে নাস্তানাবুদ হয়ে অফসাইডের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হতো।
ক্রুইফ তখন ৩-৪-৩ অর্থাৎ ডায়মন্ড ফর্মেশন ব্যবহার করতেন, যেখানে তার দুইজন ওয়াইড সেন্টার ব্যাক প্রয়োজনে প্রায়ই ফুলব্যাকের কাজ করতে পারতো। ক্রুইফ তখন তার মূল পরিকল্পনাই সাজাতেন মাঝমাঠের প্রাণভোমরা গার্দিওলাকে কেন্দ্র করে, যিনি মিডফিল্ডের পুরোটাই খুব সহজে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারতেন।
ক্রুইফের নিয়ে আসা নতুন এই প্লে স্টাইলেই বার্সেলোনা তাদের প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফি এবং টানা চারটি লিগ শিরোপা জয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু টিকিটাকার সবচেয়ে দারুণ ব্যবহার দেখিয়েছেন ক্রুইফের শিষ্য গার্দিওলা। তবে এই লেখাতে আর সেদিকে যাচ্ছি না। এখানে শুধু টিকিটাকা কী, এর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল সেটাই বলার চেষ্টা করেছি।
বার্সেলোনা আর টিকিটাকা যেন একে অপরের সমার্থক শব্দ। পৃথিবীজোড়া সমর্থকরা বার্সার যে দৃষ্টিনন্দন খেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে সবসময়, তার অন্যতম কারণ এই টিকিটাকা। অনেকেই আজকাল বলেন, টিকিটাকা এখন আর সময়ের সাথে যায় না, টিকিটাকার দিন শেষ। তবে পার্ফেক্ট টিকিটাকা আসলে প্রতিপক্ষের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর সেটা বলে বুঝানো সম্ভব না!
**********
প্রিয় পাঠক, আজকের পোস্ট এই পর্যন্ত। পোস্টটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এই ধরনের পোস্ট আরও পড়তে ডেইলি লাইভ এর সাথে থাকুন।
বার্সা আর নেদারল্যান্ডসের পাশাপাশি স্পেনের কথাও উল্লেখ করা উচিত ছিল। ২০১০ এ স্পেন টিকিটাকা ফরমেশনে খেলেই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়।
টিকিটাকা ফুটবলকে একসময় যে নান্দনিকতা উপহার দিয়েছে, এখন বোধহয় তার পালা ফুরিয়ে আসছে। সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে পাওয়ার ফুটবল।