দলছুট প্রজাপতি | আবুল হাসনাত বাঁধন
ছেলেটি বসে আছে প্যারেড মাঠের এককোনায় একা একা। চোখে তার কারও জন্যে হাজার বছরের প্রতীক্ষা। আশে পাশে অনেক মানুষ, শহরের কোলাহল। তবু সে একা, খুব একা। মাথার ওপর হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলের মেঘহীন নীল আকাশ। আশে-পাশে কয়েকটা বড়ো গাছ, যাদের পাতাগুলো বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে পাতার ফাঁকে দুই-একটা পাখি দেখা যায়। ছেলেটি বসে বসে তার প্রিয় জায়গাটি কল্পনা করে আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে কখন সে আসবে!
স্কুলের লেকের পাড় তার প্রিয় জায়গা। ছেলেটির চোখে এর চেয়ে সুন্দর জায়গা নাকি পৃথিবীতে নেই। অনেকগুলো সারি সারি নারিকেল গাছ। পাশে বিশাল মাঠ সবুজ ঘাসে ঢাকা। শরতে এই মাঠ কাশফুলে ভরে যায়। মাঠটিকে মনে হয় মেঘের ভেলা। ছেলেটি এসব দৃশ্য কিছুতেই ভুলতে পারে না। বিশেষ করে সেই ক্ষীণ স্রোতস্বিনীর কথা। কী করেই বা ভুলবে? তার জীবনটা যে মিশে আছে ওই লেকের জলে।
সবকিছু হারিয়ে ছেলেটি আজ নিঃস্ব। মাঝে মাঝে ছেলেটির ইচ্ছে হয় সে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবে। কিন্তু পারে না। কারণ সে যে আজ দল থেকে নির্বাসিত। আত্মাটা তার ভেতরেই মরে গিয়েছে। এখনো বেঁচে আছে শুধু তার অপেক্ষায়। কিন্তু সে যে আসে না, ছেলেটির অপেক্ষারও শেষ হয় না।
⏩ আরও পড়ুন: শান্তি কমিটি | আবুল হাসনাত বাঁধন
দিগন্তরেখায় গাছের ফাঁকে সূর্যটাকে আর দেখা যায় না। এমন সময় ছেলেটির সামনে এসে একটা কুকুর বসে পড়ে। কী যেন বুঝাতে চায়, কিন্তু ছেলেটি বুঝে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, তবুও সে আসে না। ছেলেটি একা একা বসে থাকে। তার মাথার ওপর এসে জড়ো হয় হাজার হাজার মশা বাহিনীর সদস্য। তাদের সাথে পেরে ওঠে না ছেলেটি। এরপর আজানের মধুর সুর বেজে ওঠে ছেলেটির কানে। কলেজের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আসে সে। ফিরে এসে দেখে তার বসার জায়গাটা দখল হয়ে গেছে। কালচে অন্ধকারে সে আবার নতুন জায়গা খুজে। একটা পেয়েও যায়। গিয়ে বসে পড়ে সেই জায়গায়।
চোখ জুড়ে এখনো শুধুই প্রতীক্ষা। জায়গাটায় এক অদ্ভুদ নীরবতা এসে ভর করে। মাথার ওপরে কুয়াশার ফাঁকে নীল আকাশে তারাদের মেলা দেখে ছেলেটির ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসি দেখা যায়। রাস্তার ধারের সোডিয়াম বাতিগুলো ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করা মানুষগুলোকে দেখে ছেলেটির মুখটা আবার ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
এরপর ছেলেটি পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢুকে। আচমকা একটা ছোট্ট হাত তার শরীর স্পর্শ করে। ছেলেটি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে, একটা ছোট্ট ছেলে। হাতে চায়ের ফ্লাস্ক আর বিস্কিট। সে ছেলেটিকে বলছে, ‘চা খাবেন ভাই?’ ছেলেটি বলে, ‘খাব না।’ এরপর সে চলে যায়।
ছেলেটি ফেসবুকে তার আপুনিকে মেসেজ দেয়, ‘মশার কামড় আর শীতের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। আর পারতেছি না,আপুনি!’ তার আপুনি ভাইয়ের পাগলামির কথা শুনে হাসতে থাকে। ভাইকে মেসেজ দেয়, ‘হা হা হা হা! তাই?’ ছেলেটি আবার রিপ্লাই দেয়, ‘হুম! কিন্তু ওকে একবার দেখলে সব কষ্ট উধাও হয়ে যাবে।’ তার আপুনি আবার হাসতে থাকে। আপুনির হাসির কথা ভেবে ছেলেটিরও হাসি পায়।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা বাড়তে থাকে, গাঢ় হতে থাকে অন্ধকার। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মশার অত্যাচার। নিশ্চুপ আকাশটায় বাড়তে থাকে তারাদের আলো। তবু সে আসে না। ছেলেটি বসে থাকে একা একা। তার বিশ্বাস সে আসবে। তাকে আসতেই হবে। গাছের পাতা বেয়ে ওপর থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ে ছেলেটির গায়ে। শহরের যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়ে ছেলেটি আজও টিকে আছে শুধু তার জন্যে।
⏩ আরও পড়ুন: পুতুলনাচের ইতিকথা : বই রিভিউ!
আজ এতদিন হয়ে গেল শহরে এসেছে, কিন্তু আজও ছেলেটি জোনাকির আলো দেখেনি। কয়েকমাস আগেও সে দল বেঁধে হাঁটত। জোনাকিরা এসে আলো ছড়াত তার চারদিকে। আজ সবাইকে হারিয়ে সে ভীষণ একা, দলছুট প্রজাপতির মতো। সত্যিই খুব একা। সবাই ছেলেটিকে পাগল বলে। কিন্তু সে জানে, সে পাগল না। স্রষ্টা এই সুন্দর পৃথিবীটা বানিয়েছে শুধুই যেন ছেলেটির জন্যে। কারণ যেসব সৌন্দর্য অন্যদের চোখে ধরা দেয় না, সেসব শুধুই ছেলেটির চোখে পড়ে।
একসময় ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটা শুরু করে। কিছু একটা দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। চোখের চশমাটা খুলে শার্ট দিয়ে পরিষ্কার করে আবার চোখে লাগায়। অবশেষে সে এসেছে! হ্যাঁ! বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে এসেছে! রাতের আধারে, ঝাপশা কুয়াশার মাঝে, অনেক মানুষের ভীড়ে প্রিয় মুখখানা চিনে নিতে কোনো ভুল হয় না ছেলেটির। একপলক দেখে নেয় ভালো করে।
এরপর তার পেছনে পেছনে চলতে শুরু করে। মশার কামড় আর শীতের কথা ভুলে যায় ছেলেটি। এখন ঠোঁট জুড়ে তার বিজয়ের হাসি। গেট পার হয়ে ছেলেটি পা বাড়ায় প্রাইভেটে যাওয়ার জন্যে। শুধু পড়ে থাকে আকাশের উজ্জল তারাগুলো আর বাতাসে ভেসে থাকা ছেলেটির স্বপ্নগুলো। আর এসবকিছুর সাক্ষী হয়ে থাকে হেমন্তের নিস্তব্ধ রাতটি…!
গল্প: দলছুট প্রজাপতি
লেখক: আবুল হাসনাত বাঁধন
রচনাকাল: ০৫/১২/২০১৪
স্থান: প্যারেড মাঠ, চকবাজার।
প্রথম প্রকাশ: ‘অন্য গল্প’ (২০১৬) যৌথ গল্প সংকলনে প্রকাশিত।
*****
⏩ আরও পড়ুন: রামগোলাম : হরিজন সম্প্রদায়ের এক অনবদ্য উপাখ্যান!
প্রিয় পাঠক, দলছুট প্রজাপতি – গল্পটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আবুল হাসনাত বাঁধনের লেখা ‘দলছুট প্রজাপতি’ এর মতন আরও নতুন নতুন গল্প পড়তে চাইলে ডেইলি লাইভে যুক্ত থাকুন।
সুন্দর শব্দশৈলী দিয়ে সাজানো সুন্দর প্লটের একটা গল্প পড়লাম।