পদ্মা নদীর মাঝি : পাঠ প্রতিক্রিয়া!

পদ্মা নদীর মাঝি : পাঠ প্রতিক্রিয়া!

পদ্মা নদীর মাঝি | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | পাঠ প্রতিক্রিয়া: ফেরদৌস আহমেদ 

বাংলা সাহিত্যের এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্ধুদের সাথে বাজি না ধরলে বিএসসি পড়ুয়া এই মেধাবী ছাত্র হয়তো থেকে যেতেন প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামেই। স্রেফ বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে যিনি লিখে ফেলতে পারেন ‘অতসী মামী’ নামের কালজয়ী গল্প তিনি যে বাংলা সাহিত্যের বুকে রাজ করতেই এসেছেন তা বুঝতে সময় লাগেনি সাহিত্যবোদ্ধাদের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল প্রাগৈতিহাসিক গল্পের মধ্য দিয়ে। সেই গল্পে ভিখু আর পাঁচীর রসায়ন বেশ দাগ কেটেছিল আমার কিশোর মনে। তারপর একে একে পড়ে শেষ করেছি মানিকের অনেকগুলো গল্প। পড়েছি পুতুলনাচের ইতিকথা, জননী এর মতো কালজয়ী সব উপন্যাস। তবে মানিককে নতুন করে চিনেছি যেই উপন্যাসে তার নাম— পদ্মা নদীর মাঝি

পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত কালজয়ী এক উপন্যাস। এক সময় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইতেও সংযোজন করা হয়েছিল এই উপন্যাসের পরিমার্জিত সংস্করণ। তাই অনেকেই হয়তো এই উপন্যাসটি পড়েছেন। তবে তার নিখাঁদ স্বাদ কিন্তু পাওয়া যাবে পূর্ণাঙ্গ সংস্করণেই। আর যে পাঠক/পাঠিকারা পড়েননি, তাদের জন্যেই আজকের এই রিভিউ!

⏩ আরও পড়ুন: হুমায়ূন আহমেদের সেরা পাঁচটি উপন্যাস!

পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় পূর্বাশা পত্রিকায়। পত্রিকায় প্রকাশের সময় উপন্যাসটির দেবীগঞ্জ ও আমিনবাড়ি জায়গা দুটির নাম ছিল যথাক্রমে রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর এর জায়গা দুটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে লেখক কেন এই নাম পরিবর্তন করলেন তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে আজও!

পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে প্রত্যন্ত এলাকার একটি জেলেপাড়ার গল্পকে আরও সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন মানিকবাবু। পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমান, মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তাভাবনা, সেখানকার মানুষের জীবনের বাঁকগুলোকে কলমের খোঁচায় উপন্যাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছিলেন তিনি স্থায়ীভাবে। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বারবার এ কথাই মনে হয়েছে আমার।

এই উপন্যাসে আপনি পাবেন কুবের নামের এক দরিদ্র মাঝিকে। যার ঘরে আছে পঙ্গু স্ত্রী মালা। আছে কপিলার মতো সুন্দরী শ্যালিকা। যার সাথে প্রায়শই ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যালাপে জড়ায় কুবের। নিষিদ্ধ প্রেমের গন্ধ লুকিয়ে থাকে তাতে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এই উপন্যাসেও আপনি পাবেন পরকীয়ার ছাপ। তবে সেসব ছাপিয়ে দরিদ্র মাঝি কুবের যেন এক আপাদমস্তক সংসারী পুরুষ। একজন স্নেহময় পিতাও বটে!

এই উপন্যাসে আপনি দেখা পাবেন হোসেন মিয়া নামের একটি চরিত্রকে। যার কর্মকাণ্ড আপনাকে মুগ্ধ করবে তাতে সন্দেহ নেই। নোয়াখালী থেকে আগত এই লোকটি ময়না দ্বীপে বসতি গেঁড়েছিল। গড়ে তুলেছিল লোকবসতি। কেমন যেন রহস্যময় এই লোকটা। যার গতিপ্রকৃতি কিছুই আন্দাজ করা যায় না। এছাড়াও এই উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলো হলো ফাতেমা, রাসু, আমিনুদ্দি, পীতম মাঝি, গণেশ, ধনঞ্জয়, রসুল প্রভৃতি। এসমস্ত চরিত্রের সমন্বয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অনিন্দ্য সুন্দর এক উপন্যাস রচনা করেছেন।

ঝরঝরে বর্ণনা ও সুনিপুণ বাক্যশৈলীর মিশ্রণ এই উপন্যাসকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা। মানুষের মধ্যকার নিষিদ্ধ প্রেম, যাপিত জীবনের যুদ্ধ কিংবা বেঁচে থাকার লড়াই, সবই যেন এক মলাটে আবদ্ধ করেছিলেন মানিক। বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চলের পটভূমিতে রচিত কীর্তিনাশা পদ্মা পাড়ের মানুষগুলোর জীবন নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটি নিয়ে বসলে শেষ না করে যেন উপায় থাকে না কোনো পাঠক/পাঠিকার। কোনো এক অবর্ণনীয় শক্তি তাকে আটকে রাখে বইয়ের পাতায়!

⏩ আরও পড়ুন: দরিয়া ই নুর : একটি বৈঠকী থ্রিলার!

যে উপন্যাসে লেখা হয়েছিল সেই অমর বাক্য— ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে! যার মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝাতে চেয়েছেন এই সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের বীভৎস রূপ। তিনি সবসময় চেয়েছেন এই সমাজ হবে মানুষের, মানবতার। সমাজতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাসী মানিকের লেখাতে এই ছাপ বেশ স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়।

এখনো পর্যন্ত যারা পড়েননি উপন্যাসটি, পড়ে ফেলতে পারবেন। দারুণ সময় কাটবে আপনার।

এক নজরে: পদ্মা নদীর মাঝি 

উপন্যাস: পদ্মা নদীর মাঝি
জনরা: সামাজিক উপন্যাস
লেখক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৬ (পূর্বাশা পত্রিকা)
ব্যক্তিগত রেটিং: ৪/৫
প্রকাশনী: প্রচলন
মুদ্রিত মূল্য: ১৩৫ ৳ 

ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

1 thought on “পদ্মা নদীর মাঝি : পাঠ প্রতিক্রিয়া!”

  1. হোসেন মিয়াই এই উপন্যাসের সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র আমার।🤭

মন্তব্য করুন:

Scroll to Top