আপনারা সবাই পরীক্ষা বিষয়টির সাথে পরিচিত। পরীক্ষা এলেই যেকোনো শিক্ষার্থীর বুক দুরুদুরু শুরু হয়। সে ভালো ছাত্র/ছাত্রী হোক কিংবা তুলনামূলক মন্দ। সবারই কমবেশি নাজেহাল অবস্থা হয় পরীক্ষার কথা শুনলে। বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া, স্কুল ও কলেজে পরীক্ষায় পাশ নম্বর হলো ৩৩ তথা ১০০ এর তিন ভাগের এক ভাগ। আপনি কি জানেন এমন পদ্ধতি কীভাবে চালু হলো? কে-ই বা চালু করল এমন পদ্ধতি? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে? তাহলে চলুন জেনে নিই— পরীক্ষায় পাশ নম্বর ৩৩ কেন হলো কিংবা এই পাশ নম্বর নির্ধারণের বিস্তারিত ইতিহাস!
পরীক্ষায় পাশ নম্বর ৩৩ কেন হলো?
পরীক্ষায় পাশ নম্বর ৩৩ হওয়ার কারণটা কিন্তু আমাদের জন্যে মোটেই সুখকর কিছু নয়। বরং বেশ অপমানজনক ও অস্বস্তিদায়কও বটে। আমাদের দেশটা যে এককালে ব্রিটিশদের অধীনে ছিল তা তো সবারই জানা। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল, গোটা ১৯০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে ইংরেজরা। আর তাদের শেখানো নিয়মেই কিন্তু চালু হয়েছিল ৩৩ নম্বরে পাশ করার এই নিয়ম।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর সরাসরি ভারতবর্ষ শাসনের ক্ষমতা হাতে নেয় ব্রিটিশ সরকার। মহারানি ভিক্টোরিয়ার আনুগত্য মেনে আনুষ্ঠানিকভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সাধারণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে এই কোম্পানি হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের শাসকদের প্রতিষ্ঠান। তবে কোম্পানির নামে নয়, ভারতবর্ষ শাসনের ক্ষমতা থাকে মূলত মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতেই। আর এই ব্রিটিশদের হাতেই ১৮৫৮ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আর তখনই পাশ নম্বর কত হবে তা নিয়ে জাগে প্রশ্ন! কত হবে সেই পাশ নম্বর? তা কি ব্রিটিশদের সমান থাকবে? নাকি ব্রিটিশদের চেয়েও কম নম্বর নির্ধারণ করা হবে? তা নিয়ে বাঁধে গোলযোগ।
পরীক্ষকরা পরামর্শ চান ব্রিটিশ লর্ডদের কাছে। তারা সিদ্ধান্ত দেন ভারতীয়দের পাশ নম্বর যেন ব্রিটিশদের অর্ধেক করে দেওয়া হয়। সে সময় ব্রিটিশদের জন্যে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ নম্বর ছিল ৬৫ নম্বর। অর্থাৎ ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৬৫ নম্বর পেলেই তাকে পরীক্ষায় কৃতকার্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আর ভারতীয়দের জন্যে এই নম্বর হয়ে যায় তারও অর্ধেক অর্থাৎ ৩২.৫ এ। এরপর ১৮৬১ সালে এই নম্বর ৩২.৫ থেকে ৩৩ এ উন্নীত করা হয়।
⏩ আরও পড়ুন: নতুন ভাষা শেখার কৌশল!
আপাতদৃষ্টিতে ব্রিটিশদের বানানো এই আইনটি ভারতীয়দের জন্যে বেশ সহজই মনে হওয়ার কথা যে কারও। যেখানে ব্রিটিশদের ৬৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করতে হতো, সেখানে কি না মাত্র ৩৩ শতাংশ নম্বর পেলেই কৃতকার্য হবে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা! শুনে নিশ্চয়ই ভালো লাগছে? তাই না?
কিন্তু আদতে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। যখন ব্রিটিশ কর্তাদের কাছে ভারতীয়দের জন্যে পরীক্ষায় পাশ নম্বর কত হবে তা নির্ধারণ করতে বলা হয়, তখন তারা বলেছিলেন, ভারতীয়দের বিদ্যা বুদ্ধি খুব বেশি নয়। বড়োজোর একজন ব্রিটিশ নাগরিকের অর্ধেক হতে পারে। আর তাই যেকোনো ভারতীয় নাগরিকের পরীক্ষায় পাশ নম্বর হওয়া উচিত ৩৩ শতাংশ। যা ছিল ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ভারতীয়দের জন্যে চূড়ান্ত অপমানজনক একটি আচরণ ও সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে সময় এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। আর তাই, এই নিয়মটিই গোটা ভারতবর্ষ এমনকি ব্রিটিশ-শাসিত সকল কমনওয়েলথভুক্ত দেশেই এই ৩৩ শতাংশ নম্বরে পাশ করার নিয়মটি চালু হয়ে যায়। যা আমাদের দেশে এখনো বলবৎ আছে।
যদিও বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবুও ৩৩ শতাংশ নম্বর পেলে পাশ করার সেই সনাতন নিয়ম আর পরিবর্তন করা হয়নি! এই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে উপনিবেশীয় ব্রিটিশ শক্তি তো দূর হয়েছে। কিন্তু দূর হয়নি তাদের রেখে যাওয়া চরম অপমানজনক এই নিয়ম।
তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক বিশ্বের সাথে মিল রেখে ন্যুনতম ৪০ শতাংশ নম্বরকে পাশ নম্বর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আর চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের পরীক্ষাগুলোর বেলায় এই পাশ নম্বর হলো ৬০ শতাংশ। মেডিকেল কলেজের যেকোনো কোর্সের পরীক্ষায় ন্যুনতম ৬০ বা তার বেশি নম্বর পেলে তবেই আপনি কৃতকার্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।
আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই উপমহাদেশের মানুষ ব্রিটিশদের বানানো অনেক নিয়ম ও আইন কানুনকে বাতিল ঘোষণা করেছে। নিজেদের সুবিধামতো আইন তৈরি করে নিয়েছে। হয়তো কোনো একদিন পরীক্ষায় পাশ নম্বরের জন্যে বরাদ্দ নম্বরটিরও পরিবর্তন করা হবে। এই উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও কলঙ্কমুক্ত হবে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি বহু আগেই। এখন বাকি তাদের রেখে যাওয়া অপ্রাসঙ্গিক ও বৈষম্যমূলক আইনগুলো থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করা।
**********
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— পরীক্ষায় পাশ নম্বর ৩৩ কেন হলো; সে সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস। এই ধরনের তথ্যমূলক পোস্ট আরও পড়তে চাইলে ডেইলি লাইভ এর সাথে থাকুন।