পুতুলনাচের ইতিকথা : বই রিভিউ!

পুতুলনাচের ইতিকথা : বই রিভিউ!

পুতুলনাচের ইতিকথা | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | পাঠ প্রতিক্রিয়া: ফেরদৌস আহমেদ 

খুব ছোটো বেলায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনেছিলাম ‘তৈলচিত্রের ভূত’ গল্পটির মাধ্যমে। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ক্লাস এইটে পড়ুয়া একটা ছেলে খোঁজ পেল আধুনিক, বিজ্ঞান মনস্ক এক লেখকের। যিনি তার লেখার মাধ্যমে ভাঙেন সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার। ঝরঝরে আকর্ষণীয় সেই লেখা ক্লাস এইট পড়ুয়া বালকটিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেই ছেলেটি, অর্থাৎ আমি একদিন খোঁজ পেলাম অসাধারণ একটি বইয়ের। পুতুলনাচের ইতিকথা নামের সেই বইটি আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখল পুরোটা সময়। যতই পড়ি, গেঁথে যাই আরও। এ যেন ছটফট করতে থাকা বড়শিগাঁথা মাছের মতন। ছাড়ানোর কোনো উপায়ই নেই। সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও আমাকে আটকে দিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পুতুলনাচের ইতিকথা বইটি যে অমর হয়ে আছে, তা বোধ করি সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন। এই বইয়ের সম্পর্কে কিছু লেখা রীতিমতো দুঃসাহসের ব্যাপার। তবুও সাহস করে বইটি সম্পর্কে ক’টি বাক্য লিখতে বসেছি!

রিভিউ

উপন্যাসের শুরুটাই হয়েছিল বেশ নাটকীয়ভাবে। হারু ঘোষের মৃ’ত্যুর মধ্য দিয়ে। বজ্রাঘাতে নি’হত হারু ঘোষের মৃ’ত্যুর বর্ণনা এতটাই চুম্বকের মতন আকর্ষণ করে যে, বইটির শুরু থেকেই যেকোনো বয়সী পাঠক তাতে আঁঠার মতন আটকে যাবেন। প্রতিটি বাক্য শেষ করার পরেই মনে হবে, পরের বাক্যে কী লেখা আছে! প্রতিটি পৃষ্ঠা শেষ করার পরেই এর পরের পৃষ্ঠায় কী আছে জানার জন্য মন তৃষ্ণার্ত হবে।

⏩ আরও পড়ুন: দরিয়া ই নুর : একটি বৈঠকী থ্রিলার!

বইটি পড়া শুরু করবার পর আমি নাওয়া খাওয়া সব গোল্লায় ফেলে বইটি শেষ করবার আগে বইটি ছেড়ে উঠতে পারিনি। বইটির প্রতিটি অংশে, প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা অত্যন্ত সাবলীলভাবে দেওয়া আছে, যা পড়তে পড়তে মোটেও একবারের জন্য থামার প্রয়োজন অনুভব করায় না। প্রাত্যহিক জীবন ও সমাজের নানা ঘটনা ও সমস্যাকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার জাদুকরী লেখার ক্ষমতার মাধ্যমে সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন।

পুতুলনাচের ইতিকথা বইটির প্রধান চরিত্রের নাম শশী। গ্রামে যাকে শশী ডাক্তার বলেই লোকে চেনে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ডাক্তার, যিনি বিজ্ঞানমনস্ক তরুণও বটে। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর যিনি শহুরে জীবনের আয়েশ আরামকে বাদ দিয়ে গ্রামের অসহায় মানুষদের কথা চিন্তা করে গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে এসে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের মানুষদের।

কুসংস্কারচ্ছন্ন এসব মানুষের সাথে চিন্তা ও জ্ঞানের পার্থক্য শশী ডাক্তার ভালোভাবেই অনুভব করেন মনে মনে। তাই তিনি বিরক্ত হয়ে বহুবার গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। কিন্তু মানবদরদী শশী ততদিনে তার জন্মভূমির গাওদিয়া গ্রামের মানুষদের সুখে দুঃখে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন। তবে শুধু এটিই একমাত্র কারণ নয়, যার জন্য শশী গ্রাম ছেড়ে যেতে পারেন না। চাইলেও সেই গ্রামেরই একজন তরুণী কুসুমের কারণে তা হয়ে ওঠে না। প্রচণ্ড বাস্তববাদী শশী বারবার কুপোকাত হয়ে যান এই গ্রাম্য, প্রায় অশিক্ষিত এক সাধারণ তরুণী কুসুমের কাছে।

ইন্টেলেকচুয়াল রোমান্টিকতার যে রসায়ন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার উপন্যাসে দেখিয়েছেন তা প্রতিটি পাঠক-পাঠিকাই টের পাবেন শশী ও কুসুমকে পড়তে গিয়ে। রোমান্সে কুসুম অনন্যা। সে অকপটে মিথ্যা বলতে পারে। শশীকে বেঁধে রাখতে পারে মুখের কথা আর ছলা কলায়! পরিণত বয়সী পাঠকেরা তাই টের পাবেন।

কুসুম চরিত্রটি ভীষণ দুর্ভেদ্য, তাকে বুঝতে হলে সম্মানহানির ঝুঁকি নিতে হয়, প্রবল আত্মবিশ্বাসী মানুষকেও দ্বিধায় পড়তে হয়। কারণ আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে কুসুমের শশী ডাক্তারের প্রতি এ প্রেম একটি বিবাহবহির্ভূত অনুভূতি। যা সামাজিকভাবে অত্যন্ত নিষিদ্ধ একটি বিষয় হলেও আবার কুসুমের এই নির্মোহ ও নির্মল প্রেমের অনুভূতির প্রতি কোনো ঘৃণাও তৈরি হয় না। এমনভাবেই কুসুম চরিত্রটিকে তৈরি করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

আলোচ্য এই উপন্যাসটিতে আমরা দেখতে পাই মানুষের মনের আপন এইসব গভীর ও গূঢ় অনুভূতিতে ঘিরে ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব দুঃখ, যন্ত্রণা ও দোটানা ঠিক কোন পর্যায়ে যেতে পারে। আসলে মানুষের মনের নানা অবদমিত গভীর কামনা-বাসনাগুলোকে নিয়ে লিখতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

⏩ আরও পড়ুন: পদ্মা নদীর মাঝি : পাঠ প্রতিক্রিয়া!

পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো- এই বইটি সাধুভাষায় লেখা হলেও সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে চলিত রীতি অনুসারে। বাংলা সাহিত্যে এমন নজির খুব কম পাওয়া যায়। আর তাই বইটি প্রকাশের পর অনেক ব্যাকরণবিদ বইটির সমালোচনাও করতে ছাড়েননি। তাতে কী? মানিক রচিত উপন্যাস তো বটেই, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে পুতুলনাচের ইতিকথা যে স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যবোদ্ধা ও সাধারণ পাঠকদের হৃদয়ে, তা তো আর অস্বীকার করা যায় না। প্রিয় পাঠক, শশী-কুসুমের ভুবনে আপনাকে স্বাগত।

এক নজরে: পুতুলনাচের ইতিকথা

উপন্যাস: পুতুলনাচের ইতিকথা
লেখক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
জনরা: সামাজিক উপন্যাস
প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৬
ব্যক্তিগত রেটিং: ৫/৫

ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

2 thoughts on “পুতুলনাচের ইতিকথা : বই রিভিউ!”

  1. রিভিউটা পড়ে বইটাও পড়ার ইচ্ছা হচ্ছে। সুন্দর লেখা।

মন্তব্য করুন:

Scroll to Top