পৃথিবীতে আধুনিক সভ্যতার জন্ম হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে। খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। নদী তীরবর্তী সেসব সভ্যতায় মানুষ শিখেছিল সমাজবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার কৌশল। উদ্ভব হয়েছিল কৃষি ও গণতন্ত্রের। সেই থেকে মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে এই পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করেছে। নির্মাণ করেছে বিচিত্র সব স্থাপনা। এমন স্থাপনাগুলোর মধ্যে সাতটি বিস্ময়কর স্থাপনাকে পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। চলুন আজ জেনে নিই— পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত।
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য
গিজার পিরামিড:
প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের সদস্যদের বলা হতো ফারাও। ফারাওদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের সাথে জড়িয়ে ছিল পরকালীন জীবনও। ফারাওরা বিশ্বাস করত মৃ’ত্যুর পরেও রয়েছে এক জীবন। মানুষ মৃ’ত্যুর পর পুনর্জন্ম লাভ করে। আর তাই ফারাওরা তাদের মৃতদেহ মমি করে পিরামিডের ভেতর সংরক্ষণ করে রাখত। সাথে দিয়ে দিত বেঁচে থাকার জন্যে সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবার ও অমূল্য সব ধনরত্ন। মূলত প্রতিটি পিরামিডই একেকটি সমাধিক্ষেত্র। এরমধ্যে সবচেয়ে বড়ো পিরামিডটি হলো গিজার পিরামিড যা Great pyramid of Giza নামেও পরিচিত। এই সমাধিক্ষেত্রটি প্রায় ৫০০০ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি ছিল ফারাও সম্রাট ‘খুফু’র সমাধিক্ষেত্র। এই পিরামিডের উচ্চতা ১৪০ মিটার বা ৪৬০ ফুট। এই পিরামিডই পৃথিবীর প্রাচীন একমাত্র সপ্তাশ্চর্য যা এখনো পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না হলে এটিও একসময় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে।
⏩ আরও পড়ুন: অনলাইন শপিং করার টিপস!
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান:
ছোটোবেলায় যখন সপ্তাশ্চর্যের তালিকা পড়েছিলেন, তখন নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে ভেবেছিলেন একটি উদ্যান কী করে ঝুলন্ত হতে পারে! আপনার মতো অনেকেই নিশ্চয়ই একই কথা ভেবেছেন, ভেবে ভেবে সদুত্তর পাননি! আপনি কি জানেন এই উদ্যানটিকে কেন ঝুলন্ত বলা হয়? সেটি জানতে হলে আপনাকে জানতে হবে এই ঝুলন্ত উদ্যান তৈরির ইতিহাস। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান তৈরি করেছিলেন ব্যাবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদজার। খ্রিস্টপূর্ব ৫০৫ থেকে ৫৬২ সালের মধ্যে এই উদ্যান নির্মাণ করা হয়। এই উদ্যান তৈরির পেছনে সম্রাটের অবদান থাকলেও মূল কারণ ছিলেন সম্রাটের স্ত্রী অর্থাৎ সম্রাজ্ঞী। সম্রাটের স্ত্রী ছিলেন মিডিয়ানের রাজকুমারী। মিডিয়ান ছিল সবুজে ঘেরা পাহাড়ি একটি রাজ্য। অপরদিকে ব্যাবিলনের চারপাশ ছিল সমতল। তাই ব্যাবিলনে এসে সম্রাজ্ঞী ভীষণ মন খারাপ করেন। তাই সম্রাট এই উদ্যান তৈরির উদ্যোগ নেন। প্রথমে উদ্যানের ভিত তৈরি করে মাটি দিয়ে ভরাট করে বৃহৎ পাহাড়ের মতো বানানো হয়। এরপর সেখানে একটি বহুতল ভবনের মতো নির্মাণ করে প্রতিটি তলায় বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ রোপণ করা হয়েছিল। ধারণা করা হয় এতে প্রায় ৫-৬ হাজার প্রজাতির গাছ ছিল, ছিল সুপ্রশস্থ বারান্দা। নির্মাণের পর এই উদ্যানটি প্রায় এক হাজার বছর টিকে ছিল। ৫১৪ খ্রিস্টাব্দে ইরানের শাসকের সাথে ব্যাবিলনের শাসকের যুদ্ধে এই উদ্যানটি ধ্বংস হয়ে যায়।
আর্টেমিসের মন্দির:
আর্টেমিসের মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দে। প্রাচীন গ্রিক এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল ইফেসাস অঞ্চলে। যা তৈরি করতে সময় লেগেছিল ১০০ বছরের বেশি। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন এই মন্দির নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ১২০ বছর। এই মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ৩৭৭ ফুট ও ১৮০ ফুট। এই মন্দিরটিতে ১২৭ টি খুঁটি বা পিলার ছিল। যার প্রত্যেকটির উচ্চতা ছিল ৬০ ফুট। মন্দিরের দেয়াল সাজানো হয়েছিল মহা মূল্যবান সব রত্নপাথর ও মণিমাণিক্য দিয়ে। গ্রিক মিথোলজির ফসল উৎপাদনের দেবী আর্টেমিসের এই মন্দিরটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৫ অব্দে ধ্বংস হয়ে যায়। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণে মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনো তুরষ্কে রক্ষিত আছে। এই মন্দিরের অনেক প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যাবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও।
অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি:
পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অলিম্পিয়ায় অবস্থিত জিউসের মূর্তিটি ছিল অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ অব্দে গ্রিক ভাস্কর ফিডিয়াস এটি নির্মাণ করেন। গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী জিউস ছিলেন দেবতাদের রাজা। তিনি ছিলেন অসীম ক্ষমতার অধিকারী। জিউসের এই মূর্তিটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৪২ ফুট। এবং এর ব্যাসার্ধ ছিল প্রায় ছয় ফুট। হাতির দাঁত ও সোনায় মোড়ানো বেদীর উপর এই মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। এই মূর্তিটি জিউসের ক্ষমতা ও অসীম শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। গ্রিকদের কাছে এই মূর্তিটি ছিল ভীষণ পবিত্র। তবে ধীরে ধীরে খ্রিস্টিয় প্রভাব বাড়তে থাকলে একসময় সমগ্র গ্রিস খ্রিস্টানদের অধীনে চলে যায়। মনে করা হয় খ্রিস্টীয় শক্তির হাতেই পঞ্চম শতাব্দীতে পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের এই অন্যতম নিদর্শনটি ধ্বংস করে ফেলা হয়।
রোডস এর মূর্তি:
প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম সম্রাট ও বীর যোদ্ধা ছিলেন মহাবীর আলেকজান্ডার। মাত্র ২৩ বছরের স্বল্প আয়ু নিয়ে তিনি পৃথিবীতে এলেও তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তার অসীম বীরত্বের জন্যে। আলেকজান্ডারের রাজত্ব ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের রোডস দ্বীপেও। আর এই রোডস দ্বীপেই নির্মাণ করা হয় সূর্যদেবতা হিলিয়াসের বিশাল এক মূর্তি। এই মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৯২ থেকে ২৮০ অব্দে। এটি লম্বায় ছিল ১০৫ ফুট। প্রায় ৪০ টন ভরের পাথরের ভিত্তির ওপর মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। এই মূর্তি তৈরিতে ব্যবহার হয়েছিল ২৫০ টন তামা বা কপার। ২২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পে মূর্তিটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় এর একটি পা পুরোপুরি ভেঙে যায়। এরপর ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সারডিন জাতি রোডস দ্বীপটি দখল করে নেয়। তারাই রোডসের এই মূর্তিটি ধ্বংস করে দেয়।
⏩ আরও পড়ুন: রিয়াল মাদ্রিদ : বিশ্বসেরা এক ফুটবল ক্লাবের গল্প!
আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর:
লাইট হাউজ বা বাতিঘর নিয়ে কমবেশি সবাই জানেন। অন্ধকার সমুদ্রে নাবিকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাতিঘর তৈরি করা হতো। খৃস্টের জন্মেরও ৩০০ বছর আগে সম্রাট দ্বিতীয় টলেমির রাজত্বকালে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের ফ্যারাস দ্বীপে একটি বাতিঘর তৈরি করা হয়। এই বাতিঘরটিই আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর বা Lighthouse of Alexandria নামেও পরিচিত। বাতিঘরটির ভিত্তিমূল ছিল ১১০ বর্ঘফুট এবং উচ্চতা ছিল ৪৫০ ফুট। এই বাতিঘরের চারপাশে ছিল একটি প্যাঁচানো সিঁড়ি। বাতিঘরটির চূড়ায় এই সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হতো। ৯৫৫ খৃষ্টাব্দে ঝড়ে এই বাতিঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৪শ শতাব্দীর একটি ভূমিকম্পে বাতিঘরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসের পূর্বে এই বাতিঘরটি কোনোদিন নিভে যায়নি। এই বাতিঘরের আলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে প্রায় ৫০ মাইল দূরবর্তী গভীর সমুদ্র থেকেও এই বাতিঘরটির আলো দেখা যেত। ধ্বংসের পর বাতিঘরটি ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে যায় যার ধ্বংসাবশেষ এখনো সাগরতলায় একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
হ্যালিকারনেসাসের সমাধি মন্দির:
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে তুরষ্কের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত কারিয়া রাজ্যে হ্যালিকারনেসাসের এই সমাধি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বানিয়েছিলেন রানি আর্তেমিসিয়া। রাজা মেলোসাসের মৃ’ত্যুর পর এটি নির্মাণ করা হয়। আর্তেমিসিয়া শুধু রাজা মেলোসাসের স্ত্রীই ছিলেন না, ছিলেন আপন বোনও! ওই সময়কার প্রেক্ষাপটে এটি ছিল বেশ স্বাভাবিক। সমাধির মূল স্তম্ভটি ১৩৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ছিল। মূল মন্দিরটি তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল। প্রথমে ছিল একটি আয়তাকার পাথুরে ভিত্তি। এরপর ঠিক দ্বিতীয় স্তরেই ছিল ৩৮টি খুঁটি বা পিলার। প্রত্যেকটি পিলারের উচ্চতা ছিল ৫৬ ফুট। তৃতীয় স্তরটি ছিল বিশাল পিরামিড আকারের একটি গম্বুজ। এই গম্বুজটির উচ্চতা ছিল ৫০ ফুট। ধারণা করা হয় কোনো এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে এই দৃষ্টিনন্দন সমাধি মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। আবার প্রচলিত আছে, গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের তুরস্ক আক্রমণকালে এই মন্দিরটিকে ধ্বংস করা হয়।
**********
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য সম্পর্কে বিস্তারিত। আশা করি পোস্টটি আপনাদের ভালো লেগেছে। পোস্টটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এই ধরনের পোস্ট আরও পড়তে ডেইলি লাইভ এর সাথে থাকুন।
নতুন বেশ কিছু নাম জানতে পারলাম।