মরণোত্তর অঙ্গদান : বহু জীবন রক্ষাকারী মহৎ উদ্যোগ!

মরণোত্তর অঙ্গদান : বহু জীবন রক্ষাকারী মহৎ উদ্যোগ!

সম্প্রতি সারা ইসলাম নামের এক তরুণী তার সাহসী কর্মকাণ্ডের জন্য সংবাদপত্রে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামক একটি রোগে আক্রান্ত ছিলেন যা নিরাময় করা যায়নি এবং মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি মা’রা যান। কিন্তু তিনি মা’রা যাওয়ার পরেও, তিনি তার কিডনি দিয়ে দুজন মানুষকে উন্নত জীবন পেতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি আরও দুজন মানুষকে তার কর্নিয়া দিয়ে চোখ দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে সাহায্য করেছিলেন। এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ একটি মহৎ কাজ ছিল। কারণ বাংলাদেশে এটি প্রথমবারের মতো ঘটেছে; একজনের কিডনি মা’রা যাওয়ার পরে অন্য কাউকে দেওয়া হয়েছিল। সারাহ তার উদারতার জন্য এবং অন্যদের সাহায্য করার জন্য, তার চলে যাওয়ার পরেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। যাই হোক, ডেইলি লাইভের আজকের পোস্টে আমরা— মরণোত্তর অঙ্গদান: বহু জীবন রক্ষাকারী এই মহৎ উদ্যোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন শুরু করা যাক।

মরণোত্তর অঙ্গদান : বহু জীবন রক্ষাকারী মহৎ উদ্যোগ!

কখনো কখনো একজন ব্যক্তির শরীরের একটি অঙ্গ যখন ভালো ভাবে কাজ করে না, তখন এটি প্রতিস্থাপনের দরকার পড়ে। হয়তো এই নতুন অঙ্গ একটি প্রাণী থেকে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বেশি ভালো হয় যদি এটি অন্য কোনো ব্যক্তির (মানুষ) কাছ থেকে নেওয়া হয়। একমাত্র অঙ্গ প্রতিস্থাপন এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাবত ক্রনিক ডিজিজে ভোগা রোগীদের সুস্থ করে তোলা বা ভালো রাখা যায়।

⏩ আরও পড়ুন: মানবদেহে বাস করা ভয়ঙ্কর কিছু পরজীবী!

অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ধরন

অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট হলো— যখন একজন ব্যক্তির দেহ থেকে অঙ্গ বের করে অন্য ব্যক্তির শরীরে স্থাপন করা হয়। এটি প্রাণী থেকে মানুষে বা একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষে হতে পারে। যদি একজন ব্যক্তি বেঁচে থাকেন, তবে সে অন্য কাউকে সাহায্য করার জন্য কিডনি, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, লিভার বা পরিপাকতন্ত্রের অংশগুলির মতো কিছু অঙ্গ দান করতে পারেন। একে জীবন্ত দাতা প্রতিস্থাপন বা লিভিং ডোনার বলা হয়।

যখন কেউ মা’রা যায়, তখন তাদের শরীরের কিছু অঙ্গ অসুস্থ অন্য লোকেদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে তাদের কিডনি, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, অগ্ন্যাশয় এবং তাদের পাকস্থলীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমনকি তাদের চোখ কাউকে ভালোভাবে দেখতে সাহায্য করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। হার্টের ভাল্ব, ত্বক এবং টেন্ডনগুলির মতো কিছু অন্যান্য অংশও জীবিত লোকেদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। একে ক্যাডেভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট (Cadavaric transplant) বলা হয়। উন্নত চিকিৎসাসেবা আছে এমন দেশগুলিতে, প্রতিস্থাপিত অঙ্গগুলির শতকরা ৮০-৯০ ভাগ মৃ’ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসে।

ইতিহাস

১৯৬৮ সালে জাপানের একজন সার্জন একটি অস্ত্রোপচার করেছিলেন, যেখানে তিনি একজনের হার্ট নিয়েছিলেন এবং অন্য একজনকে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অস্ত্রোপচারের সময় দুজনেই মা’রা যান। এই কারণে ন’রহ’ত্যার অভিযোগে তাকে আদালতে যেতে হয়। এর পরে, ডাক্তার এবং আইন প্রণেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ইতিমধ্যেই মা’রা গেছেন এমন লোকেদের অঙ্গ ব্যবহার করা নিরাপদ এবং ভালো। তারা একটি নিয়ম তৈরি করেছিলেন— প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গ কেবলমাত্র মৃ’ত ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া যেতে পারে। এই নিয়মটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ডাক্তারদের জানতে সাহায্য করেছিল যে, কখন মা’রা গেছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে অঙ্গ নেওয়া ঠিক হবে।

⏩ আরও পড়ুন: এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম : অদ্ভুত একটি মাথার রোগ!

চিকিৎসা বিজ্ঞানে কখন মানুষকে মৃ’ত ঘোষণা করা হয়?

সাধারণত মানুষ মনে করে যে হ্রদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে একজন ব্যক্তি মা’রা যান। একে কার্ডিয়াক ডে’থ বলে। অর্থাৎ শরীরে রক্ত ​​চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর জন্য আরেকটি পরিভাষা হল সংবহনজনিত মৃ’ত্যু। চিকিৎসকরাও কার্ডিয়াক ডে’থকে এক ধরনের মৃ’ত্যু বলে মনে করেন। তবে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো দ্রুত কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তাই, সফল প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য হার্ট এখনো পাম্প করার সময় ডাক্তাররা প্রতিস্থাপনের জন্য এই অ’ঙ্গগুলি বের করার চেষ্টা করেন।

১৯৯০ এবং ৮০ এর দশকে, ডাক্তাররা একজন ব্যক্তির মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করার একটি উপায় নিয়ে এসেছিলেন। এর মানে হলো যে- যদিও তাদের হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুস এখনো মেশিনের সাহায্য চলতে পারে, কিন্তু তারা আর জেগে উঠতে বা চিন্তা করতে সক্ষম হবে না। এ কারণে কিছু দেশ এখন ব্রেন ডে’থ সহ কাউকে আইনত মৃ’ত বলে মনে করে। ডাক্তাররা তাদের মস্তিষ্কের স্টেমের নির্দিষ্ট স্নায়ু পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন যে কারও মস্তিষ্ক মৃ’ত কিনা। যদি এই স্নায়ুগুলো আর কাজ না করে, তাহলে এর মানে মস্তিষ্ক স্থায়ীভাবে ড্যামেজ হয়ে গেছে। যখন কেউ ক্লিনিক্যালি মা’রা যায়, তার মানে তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

কিছু দেশে এখনো ক্লিনিক্যাল ডে’থ বলতে ব্রেন ডে’থকে বোঝানো হয়। ডাক্তাররা মৃ’ত ব্যক্তির শরীর থেকে কিছু অঙ্গ বের করে অন্য লোকেদের শরীরে ট্রান্সফার করতে পারেন যাদের প্রয়োজন। অঙ্গগুলি বের করা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা মেশিনের সাহায্যে ব্যক্তির হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুসগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে সম্পূর্ণ মৃ’ত ব্যক্তি থেকে কর্নিয়া, কিডনি, লিভার এবং অগ্ন্যাশয়ের মতো নির্দিষ্ট অঙ্গগুলি বের করা যেতে পারে।

অর্গান ট্রান্সফার নিয়ে বাংলাদেশের চিত্র

বাংলাদেশে, মানুষ ১৯৮২ সালে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা শুরু করে। তারা জীবিত ডোনার এর কাছ থেকে কিডনি নিতে এবং রোগীদের মধ্যে স্থাপন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু মৃ’ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুধুমাত্র কর্নিয়া নিতে পারে। অন্য কোনো অঙ্গ নিতে পারেনি। ফলে অর্গান ট্রান্সফার দরকার এমন বহু রোগী পর্যাপ্ত অর্গান এর অভাবে চিকিৎসা নিতে পারেনি। অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ঠিক হবে কিনা তা নিয়েও মানুষের বিভিন্ন মতামত ছিল।

তারপরে, ১৯৯৯ সালে, সরকার একটি নিয়ম তৈরি করেছিল যাতে বলা হয়েছিল যে- কেউ বেঁচে আছে, সে তাদের অঙ্গগুলি এমন কাউকে দিতে পারে যেগুলো তাদের প্রয়োজন। কিন্তু তালিকায় মাত্র কয়েকজনের নাম থাকায় কিছু লোক অবৈধভাবে অঙ্গ বিক্রি শুরু করে। ফলে, ২০১৮ সালে এই অবৈধ অঙ্গ বিক্রি বন্ধ করার চেষ্টা স্বরূপ নিয়ম পরিবর্তন করা হয়।

⏩ আরও পড়ুন: গ্যাসের চুলা ব্যবহার করা কি ক্ষতিকারক?

সারা ইসলাম চেয়েছিলেন আরও বেশি মানুষ মা’রা যাওয়ার পরে তাদের অঙ্গ দান করুক, কিন্তু এখনই যথেষ্ট লোক তা করছে না। তিনি আশা করেছিলেন যে- এটি সম্পর্কে কথা বলার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ তাদের অঙ্গ দান করার কথা ভাবতে শুরু করবে। আগে, লোকেরা রক্ত ​​বা কর্নিয়া দান করতে চাইত না, কিন্তু এখন তারা করে, কারণ তারা জানে যে এটি অন্যদের সাহায্য করে। সারা এও চাইতো যে, মৃ’ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে অঙ্গ ব্যবহার করার জন্য আরও সমর্থন থাকুক, কারণ এটি অনেক জীবন বাঁচাতে পারে। মৃ’ত্যুর পরেও সারা ইসলাম মরণোত্তর অঙ্গদান করে এই মহৎ কাজের জন্য মানুষের মনে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন! আরও মানুষ তার অনুসরণে এই মহৎ উদ্যোগে এগিয়ে আসুক, আমরা সেই কামনা করি।

**********

প্রিয় পাঠক, এই ছিল— মরণোত্তর অঙ্গদান : বহু জীবন রক্ষাকারী এই মহৎ উদ্যোগ সম্পর্কে বিস্তারিত! আজকের পোস্ট এই পর্যন্ত। আশা করছি, আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগেছে। আপনার যেকোনো ধরনের প্রশ্ন কিংবা মতামত জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ডেইলি লাইভ এর সাথে থাকুন সবসময়। আপনার দিনটি শুভ হোক।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

1 thought on “মরণোত্তর অঙ্গদান : বহু জীবন রক্ষাকারী মহৎ উদ্যোগ!”

  1. মৃত্যুর পর শরীর মাটিতে মিশে যায়। তাই, অসুস্থ মানুষকে অঙ্গ দান করে যাওয়া সত্যিই মহৎ উদ্যোগ। আমারও এমন ইচ্ছে রয়েছে।

মন্তব্য করুন:

Scroll to Top