মশা! জনজীবন প্রায়শই অতিষ্ট ও আতংকে থাকে ছোটো এই মশার অত্যাচারে। ডেঙ্গু প্রকোপের প্রধান কারণ হিসেবে মশাকেই দোষিত করা হয়, কারণ ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস ক্ষুদ্র এই কীট এর মাধ্যমেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। তাই বলে শুধু ডেঙ্গু নয়, মশা আরও অনেক রোগের ভাইরাসও বহন করে। যেমন— জিকা, ফাইলেরিয়াসিস, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি। তাহলে চলুন, ডেইলি লাইভের আজকের আলোচনায় আমারা জেনে নিই— মশাবাহিত ছয়টি ভয়ংকর রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত।
মশাবাহিত ছয়টি ভয়ংকর রোগ
বাহক মশা
কিউলেক্স, অ্যাডিস আর অ্যানোফিলিস; মশার এই তিনটি প্রজাতি এসব রোগের ভেক্টর বা জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। কিউলেক্স সবসময় আমাদের ঘরবাড়ির আশেপাশে পাওয়া যায়, অ্যাডিস আসে মৌসুমি অতিথি হয়ে। অ্যানোফিলিস সবসময় পাওয়া যায় না, তবে এদের পার্বত্য অঞ্চলেই বেশি পাওয়া যায়।
⏩ আরও পড়ুন: মানবদেহে বাস করা ভয়ঙ্কর কিছু পরজীবী!
রোগ
চিকুনগুনিয়া
একবিংশ শতাব্দীর প্রথমে অন্তত ১১বার ভারত উপমহাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রচুর প্রকোপ অনুধাবন করা গিয়েছিল। যা ২০০৮ আর ২০১১ সালে ক্ষুদ্র আকারে দেখা দিয়েছিল বাংলাদেশে, আর মহামারীতে পরিণত হয়েছিল ২০১৭ সালে। এরপর থেকে প্রতি বছর গরমের সময় চিকুনগুনিয়া প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই ভাইরাসের নাম Chikungunya Virus /CHIKV। নারী অ্যাডিস মশা দ্বারা এই জীবাণু বাহিত হয়। মশা রক্ত চুষে নেওয়ার সময় এ ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। বিশেষত অনেক জ্বর, শরীরে লালচে দাগ আর গিরায় ব্যাথা (Joint Pain) এই রোগের প্রধান লক্ষণ, যার কিনা অনেকটাই মিলে যায় ডেঙ্গুর সাথে। প্রত্যেকদিনের কাজকর্ম পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে- চিকুনগুনিয়ার কারণে অস্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য, এবং রোগ ভালো হওয়ার পরেও সামান্য ব্যথা অনুভূত হতে পারে বছরখানেক।
যদিও চিকুনগুনিয়া মারাত্মক রোগ নয় এবং পরবর্তিতে এমনিতেই সেরে যায়। তবে কিছুসংখ্যক রোগীর জন্য লিভার, হৃদযন্ত্র, স্নায়ু এমনকি শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গর্বভতী অবস্থায় এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বা ভ্রুণের সংক্রমণের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
ডেঙ্গু
ডেঙ্গু রোগের ভাইরাসও মশা দ্বারা বাহিত হয়ে থাকে। চিকুনগুনিয়ার মতোই নারী অ্যাডিস মশা-ই ডেঙ্গু রোগের বাহক। ষাটের দশকে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলেও, মূলত ডেঙ্গু আমাদের দেশে ২০০০ সালের পর থেকে বড়ো একটা স্বাস্থ্য সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। ঢাকা’র জ্বর (Dacca fever) বলে তখন একে আখ্যায়িত করা হতো। বর্তমানে ডেঙ্গু মহামারী প্রতিবছরই লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization), বাংলাদেশকে ডেঙ্গুর জন্য বিপদজনক হিসেবে মার্ক করেছে। তাদের তথ্য সংগ্রহ অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫২% লোক এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ অনেকটা একইরকম। ডেঙ্গু হলে জ্বর থাকে প্রায় ১০৩-১০৪° ফারেনহাইট, হাড়গোড়ে আর মাংসপেশীতে ব্যথা, শরীর ব্যথা, শরীরে ফোস্কা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত রোগী ২-৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে শরীরে কিছু কিছু উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। যেমন- শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড পেটব্যথা বা পেট ফুলে যাওয়া, বমি হওয়া, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়া ইত্যাদি। ডেঙ্গু সন্দেহভাজন মনে হলে অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশে অন্যান্য জ্বরের চেয়ে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুহার বেশি।
⏩ আরও পড়ুন: এক্সপ্লোডিং হেড সিনড্রোম : অদ্ভুত একটি মাথার রোগ!
ম্যালেরিয়া
ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি মানুষ ম্যালেরিয়াকেও মশাবাহিত রোগ হিসেবে জানে। পরজীবী বা প্যারাসাইটজনিত এই রোগ নারী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি হতে অন্যের শরীরে ছড়ায়। বাংলাদেশের- ভারত আর মায়ানমারের সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলায় সারা বছরই ম্যালেরিয়া রোগ দেখা যায়। ফলে সেইসব এলাকায় কেউ ঘুরতে যাওয়ার আগে ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে যাওয়া উচিত।
ম্যালেরিয়া হলে শুরুতে হালকা জ্বর হলেও পরবর্তীতে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। জ্বরের পাশাপাশি থাকে বেশ ক্লান্তি, মাথাব্যথা আর মাংসপেশীতে ব্যথা। কোনো রোগীর ক্ষেত্রে রক্তশুন্যতা আর জন্ডিসও দেখা দিতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই, কারণ ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা ও ভালো কিছু ওষুধ রয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ খেলে এই রোগ দ্রুত ভালো হয়ে যায়।
এনকেফালাইটিস
ব্রেইনের একধরনের ইনফ্ল্যামেশনকে এনকেফালাইটিস বলা হয়ে থাকে। ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, জাপানিজ এনকেফালাইটিস ভাইরাস বা জেই (Japanese Encephalitis), এইসব ভাইরাস থেকে এই রোগ হতে পারে। কিউলেক্স প্রজাতির মশা দিয়ে এই রোগ দুটি ছড়ায় এবং বাংলাদেশে বেশি দেখা যায় এই প্রজাতির মশা।
জেই ভাইরাস দ্বারা ঘটিত এনকেফালাইটিসই বেশি দেখা যায় এশিয়াতে। বাংলাদেশে গবেষণার সল্পতা থাকলেও একেই মূল কালপ্রিট বলে অ্যাখায়িত করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে জীবাণুবাহক মশা কামড়ানোর ফলে ৫-১৫ দিনের মধ্যে রোগীর বমি, জ্বর, মাথাব্যথা এসব উপসর্গ দেখা দেয়। এর সাথে খিঁচুনি, ঘাড়ব্যথা বা ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, ইত্যাদিও হতে পারে। এনকেফালাইটিস মারাত্মক একটি রোগ, তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন।
জিকা
জিকা ভাইরাসও নারী অ্যাডিস মশা দ্বারা বাহিত হয়, এবং পরবর্তিতে তা রোগের কারণ হয়ে দাড়ায়। অন্যসব ভাইরাস এর মতোই এই রোগের লক্ষণগুলো। পাশাপাশি চোখ লাল হতে পারে। সাধারণত এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি এক সপ্তাহ পর ভালো হয়ে যান।
জিকার সংক্রমণ গর্ভবতী মায়েদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সন্তান ধারণ অবস্থায় মা যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে বাচ্চা নানারকম শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিতে পারে, একে Congenital Zika নামে ডাকা হয়। এমন কী প্রসব হওয়ার সময় আসার পূর্বেই বাচ্চা হয়ে যেতে পারে কিংবা বাচ্চা নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস
এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষের হাত পা ফুলে যায়। বহু আগে ঢাকা শহরে এমন আক্রান্ত মানুষ দেখা যেত। লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস নামে পরজীবী আক্রমণের ফলে এই রোগ হয়ে থাকে। তিন প্রজাতির মশা-ই (কিউলেক্স, অ্যাডিস, অ্যানোফিলিস) এদের বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে। এই রোগের শুরুই হয় লসিকা গ্রন্থির সংক্রমণ থেকে। একসময় বাংলাদেশ এই সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল, তবে বিভিন্ন প্রতিষেধক ও উন্নত চিকিৎসায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। নিয়মিত পরিচর্যা ও চিকিৎসার ফলে বহু মানুষ ভালো হয়েছেন।
⏩ আরও পড়ুন: মরণোত্তর অঙ্গদান : বহু জীবন রক্ষাকারী মহৎ উদ্যোগ!
প্রতিরোধ
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, মশা দ্বারা ছড়াতে পারে বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর রোগ। তাই বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা, বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে না দেওয়া দরকার, যাতে করে মশা বংশবৃদ্ধি করতে না পারে। তার পাশাপাশি ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা উচিত। অসুস্থ হলে, যেকোনো প্রয়োজনে ডাক্তার এর পরামর্শ নিতে হবে যাতে করে, আমরা সবাই দ্রুত সেরে উঠতে পারি এবং সুস্থ থাকতে পারি।
**********
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— মশাবাহিত ছয়টি ভয়ংকর রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত। আশা করছি, আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগেছে। আপনার যেকোনো ধরনের প্রশ্ন কিংবা মতামত জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ডেইলি লাইভ এর সাথে থাকুন সবসময়। আপনার দিনটি শুভ হোক।
ভয়ংকর। একবার এসব রোগ যার হয়েছে, সে কেবল এর যন্ত্রণা অনুভব করতে পারবে! যাই হোক, খুব ইনফরমেটিভ লেখা। ধন্যবাদ।