মোহাম্মদ আশরাফুল, বাংলাদেশী ক্রিকেটার। হতে পারতেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড়ো তারকা, এ দেশের ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকা। নিজের মধ্যে ছিল না প্রতিভার কোনো কমতি। কিন্তু পারেননি, হয়ে রইলেন দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড়ো আফসোসগুলোর একটি। অসাধারণ একজন ব্যক্তি, যিনি হয়তো বিপ্লব এনে দিতে পারতেন গোটা ক্রিকেট খেলাটাতেই। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দৃশ্যপটে এসে, আশরাফুল দারুণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতিচ্ছবি হওয়ার। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, অফ ফর্ম আর ফিক্সিংয়ের দায়ে সবকিছুই যেন কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কথা হবে সেসব নিয়েই, আশরাফুলের উত্থান, পতন আর স্বপ্ন দেখানোর গল্প নিয়ে। চলুন জেনে নিই— বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার, মোহাম্মদ আশরাফুল এর জীবন ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে!
মোহাম্মদ আশরাফুল : দেশের ক্রিকেটের এক আক্ষেপ
প্রারম্ভ
১৯৮৪ সালের ৭ জুলাই ঢাকায় জন্ম নেওয়া আশরাফুল ছোটোবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন। আর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে দেশের ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগও পেয়েছিলেন খুব অল্প বয়সেই।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে, তিনি ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট সেঞ্চুরি করেন। সেখান থেকেই তার প্রতিশ্রুতিশীল ক্যারিয়ারের সূচনা হয়। তিনি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্রোক খেলা, ভিন্নধর্মী শট এবং আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত ছিলেন। ২০০৫ সালে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আশরাফুলের স্মরণীয় ইনিংস একজন প্রতিভাধর ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর খ্যাতিকে নতুন মাত্রা দান করে করে! কেন না সেই ম্যাচে অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতে তিনি প্রথমবারের মতো কোনো ক্রিকেট মোড়লের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে তাদের প্রথম ওয়ানডে জয়ের পথ দেখিয়েছিলেন।
তাঁর প্রথম দিকের সাফল্য সত্ত্বেও, আশরাফুল তাঁর পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হিমশিম খেয়েছেন। একটা সময় এসে দেখা গেল, তিনি প্রায়ই দুর্বল শট নির্বাচন করছেন এবং তাঁর খেলার স্বভাবসুলভ ভঙ্গি হারিয়ে ফেলছেন। ফলে নিজের ইনিংসগুলো বড়ো স্কোরে রূপ দিতে আশরাফুল ক্রমাগতই ব্যর্থ হতে শুরু করেন।
⏩ আরও পড়ুন: সাকিব আল হাসান : সেরাদের সেরা বাঙালি ক্রিকেটার!
ফিক্সিং ইস্যু
২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে আশরাফুলের অধিনায়কত্বের সময়টাও ছিল চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ, কারণ তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তখন ম্যাচ জিততে টানা লড়াই করেও তেমন কোনো ফল পাচ্ছিল না। এরপর মাঠের বাইরে, তিনি ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগের সাথে সম্পর্কিত বিতর্কের মুখোমুখি হন, যা তার ক্যারিয়ারের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) সময় ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আশরাফুলের ক্যারিয়ারে একটি বড়োসড়ো আঘাত আসে। অভিযুক্ত হওয়ার পর তদন্তের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে নেন এবং পরবর্তীতে দুই বছর স্থগিতসহ আট বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন। এই সময়টা নিঃসন্দেহে আশরাফুলের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় ছিল। যাই হোক, তিনি এই সময়ে নিজেকে খেলা থেকে দূরে রেখে তাঁর ভুলগুলো সংশোধন করতে, এবং জীবনকে পুনরায় গুছিয়ে নিতে শুরু করেন।
ক্রিকেটে ফেরা
২০১৬ সালে, আশরাফুলের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় এবং তাকে আবারও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেওয়া হয়। নিজেকে সংশোধন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ আশরাফুল, তাঁর ফর্ম ফিরে পেতে এবং ক্রিকেটীয় ট্র্যাকে ফিরতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পুরোনো প্রতিভার ঝলক মাঝেমধ্যে দেখতে পাওয়া গেলেও, জাতীয় দলের ফেরার সম্ভাবনা আর তৈরি করতে পারেননি সম্ভাবনাময়ী এই ক্রিকেট তারকা।
অস্বাভাবিক রকমের উত্থান-পতন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেটে আশরাফুলের অবদানকে উপেক্ষা করা যায় না। প্রথমদিকে যারা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছেন, আশরাফুল তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। এর বাইরেও ক্রিকেটের বড়ো দেশগুলোর বিপক্ষে তাঁর অসাধারণ সব ইনিংসগুলো দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পরিশেষ
মোহাম্মদ আশরাফুল এর ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল একটি আবেগভরা রোলারকোস্টার। যার রাইডের একেকটা অংশ ছিল একেকরকম। কখনো অসীম প্রতিভা, কখনো অসংলগ্ন পারফরম্যান্স, কখনোবা ভুলের কড়াল থাবা কিংবা মুক্তির কঠোর সংগ্রাম। নানা ভুল-ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও আশরাফুল লাল-সবুজদের ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। যাকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই দেশের ক্রিকেটের ইতিহাস লেখা সম্ভব না। একইসাথে আশরাফুলের গল্পটা উচ্চাকাঙ্খী ক্রিকেটারদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হিসেবেও কাজ করবে সবসময়।