বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকে ডেকে থাকেন প্রেমের কবি বলে! এই প্রেম শুধুমাত্র তার কাব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ব্যক্তিজীবনেও রবীন্দ্রনাথ প্রেমে পরিপূর্ণ ছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথের জীবনে যত প্রেম এসেছিল, ওগুলো সম্পর্কে অনেক সাধারণ পাঠক জানেনই না। বারবারই তাঁর জীবনে এসেছে প্রেমের জোয়ার। শ্রাবণের ধারার মতন ঝরে পড়েছে প্রেম। প্রেমরস আস্বাদনের জন্য রবীন্দ্রনাথের রচনার কোনো জুড়ি নেই। প্রেমানুভূতির জন্য রবীন্দ্রনাথ কখনো নারী শরীরকে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করেননি। প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে তিনি বরাবরই গৌণ রূপে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ, বলা যায় অনেকটাই ভিক্টোরিয়ান আদর্শমত দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সে সময়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের চিন্তাভাবনায়, পাশ্চাত্য শিক্ষার হাত ধরে অনেকটাই পরিবর্তন আসে। প্রেম ভালোবাসার মতন অনুভূতিও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ফলে ইউরোপীয় ‘পিউরিট্যানিজম’ বা ‘বিশুদ্ধতাবাদী’ চিন্তাভাবনাও প্রেমের অনুভূতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল। যেখানে প্রেমে শারিরীক উপস্থিতির চেয়ে বিশুদ্ধতার চর্চা বেশি হতো।
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে মানুষের আবেগ অনুভূতির পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে প্রেমের প্রকাশেও। জীবনানন্দ বা নজরুলের কবিতায় নারীর সরব উপস্থিতি যেমন আমরা দেখতে পাই। চাইলেই তাঁদের হাত ধরা যায় বা চিবুক ছুঁয়ে দেওয়া যায়! কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের রচনায় তেমন দেখতে পাই না আমরা। রবীন্দ্রনাথ তার প্রেমের নারীকে দেবীরূপে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল, সুক্ষ্ণ রুচির ও প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষ। ফলে তার প্রেমেও আমরা তার অতি আবেগপূর্ণ, সুক্ষ্ণ প্রেমানুভূতির পরিচয় পাই। এহেন প্রেমের কবির জীবনেও সতেরো থেকে ষাট বছর বয়স পর্যন্ত বহুবার প্রেম এসেছে। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে।’
এদের মধ্যে অনেকের নাম তার সাথেই উচ্চারিত হয়েছে, অনেকে হারিয়ে গিয়েছেন কালের গর্ভে। আজকের পোস্ট তাঁর কয়েকজন প্রেয়সীকে নিয়ে লিখব। চলুন জেনে নিই— রবীন্দ্রনাথের জীবনে যত প্রেম ছিল, সেগুলো সম্পর্কে!
রবীন্দ্রনাথের জীবনে যত প্রেম
কাদম্বরী দেবী
কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম প্রেম হয়ে আসে কাদম্বরী দেবী। কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে তাঁর বউঠান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বড়ো ভাই জ্যোতিন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের প্রণয়িনীদের কথা আসলেই সবার আগে উচ্চারিত হয় কাদম্বরী দেবীর নাম। তবে তাঁকে নিয়েই বলা সবচেয়ে কঠিন। আদতে তাঁদের মধ্যে ভালোবাসার গভীরতা কতটা ছিল, তাঁর আবেদনের মাত্রা কেমন ছিল তা আমরা রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখা হতে বুঝতে পারি। কিন্তু, অপর পক্ষ হতে কাদম্বরী দেবীর অনুভুতি কী ছিল তা আমরা কখনোই জানতে পারিনি। তাঁর এ ব্যাপারে কোনো লেখা কখনো লোকসম্মুখে আসেনি। রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে যদিও তাঁর লেখায় আলো-আধারির আশ্রয় নিতেই বেশি পছন্দ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের “বধু” কবিতা, যেটি আকাশপ্রদীপ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত, সেখানে কাদম্বরী দেবীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রেম প্রকাশিত হয়েছে এভাবে—
“বালকের প্রাণে
প্রথম সে নারী মন্ত্র আগমনী গানে
…কানে কানে ডেকেছিলে মোরে
অপরিচিত কণ্ঠ স্নিগ্ধ নাম ধরে”
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাসের মাথায় মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন কাদম্বরী দেবী। জানা যায় মৃত্যুর আগে কাদম্বরী একটি পত্র লিখে গিয়েছিলেন। যেটি রবীন্দ্রনাথের বাবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। এভাবেই পত্রের সাথে সাথে কাদম্বরীও পঞ্চভুতে বিলীন হয়ে যান।
⏩ আরও পড়ুন: অসমাপ্ত আত্মজীবনী : ব্যতিক্রমী এক আত্মজীবনী!
আন্না তড়খড়
১৮৭৮ সালে কিশোর রবীন্দ্রনাথকে তাঁর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু আত্মারাম পান্ডুরঙের বাসায়, বোম্বেতে পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজী ভাষা শেখানো ও বিলেতি আদব কায়দা রপ্ত করানো। সেই পরিবারের বিলেত ফেরত সুন্দরী কিশোরী আন্না তড়খড়কে দেওয়া হয়েছিল দায়িত্ব। আন্না তড়খড়ের সাথে এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ গভীর ও আবেগপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তাঁর বেশিরভাগ সম্পর্কের মতো এই সম্পর্কও পরিণতি পায়নি কোনো। কবি ভালোবেসে মারাঠি এই কিশোরীর নাম দিয়েছিলেন নলিনী। পরবর্তীতে বহু কবিতায় বারবারই নলিনীর নাম উঠে এসেছে। ভালোবেসে কবি নলিনীকে লিখেছিলেন—
“শোন নলিনী, খোল গো আঁখি
ঘুম এখনো ভাঙিল না কি?
দেখ তোমারি দোয়ারে ডাকে
সখী, এসেছে তোমার রবি”
পরবর্তীতে আন্নার সাথে বারোদা কলেজের উপাধ্যাক্ষ হ্যারল্ড লিটেল বলের বিবাহ হয় ১৮৭৯ সালে। ১৮৮১ সালে মারা যান আন্না।
রানু অধিকারী
কবির যৌবন যখন পশ্চিম গগণে, তখন ছাপ্পান্ন বছর বয়সে কবির জীবনে আবারও প্রেম আসে। কাশির এক অধ্যক্ষের মেয়ে কিশোরী রানুর সে সময় বয়স ছিল মাত্র পনেরো। প্রেম বড়োই অদ্ভুত, যা মানে না কোনো বয়স, জাত-পাত বা ধর্মের বাধা।
কবি রানুকে নিয়ে লিখেছিলেন—
“ওগো তুমি পঞ্চদশী,
তুমি পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে“
অসম বয়সী তাদের এই অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্কটি বজায় ছিল দীর্ঘ আট বছর। ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত। তাঁদের ভালোবাসার মধ্যে, তাঁদের উভয়ের একজনের আরেকজনের প্রতি নির্ভেজাল আবেগের কোনো অস্পষ্টতা না থাকলেও তাঁদের সম্পর্ক ঠিক প্লেটোনিক ছিল কিনা তা দূর থেকে বলা যায় না। শেষ পর্যন্ত পরিবারের ইচ্ছায় রানুর বিয়ে হয়ে যায় স্যার বীরেন মুখোপাধ্যায়ের সাথে। শেষ বয়সে কবির মৃত্যুর আগে আগে তাঁদের দুজনের আবার অবশ্য দেখা হয়েছিল!
*****
উল্লেখ্য যে, এই সম্পর্কগুলি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সারাজীবনে বহু নারীর সঙ্গেই নিবিড় প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্কগুলি প্রায়শই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিক আদান-প্রদানের সাথে জড়িত ছিল। জড়িত ছিল রোমান্টিকভাবেও। তাঁর জীবনের এসব প্রেম, আকাঙ্খা এবং বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। আর তাই তো প্রেমের প্রতি আকুল অন্বেষণ, আবেগ, আকুলতা তাঁর কবিতা, গান এবং নাটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।