রামগোলাম : হরিজন সম্প্রদায়ের এক অনবদ্য উপাখ্যান!

রামগোলাম : হরিজন সম্প্রদায়ের এক অনবদ্য উপাখ্যান!

রামগোলাম | হরিশংকর জলদাস | পাঠ প্রতিক্রিয়া: ফেরদৌস আহমেদ 

আপনাদের কি কখনো হরিজন সম্প্রদায়ের কথা জানতে ইচ্ছা করেছে? সমাজেরই একটা অংশ অথচ সমাজ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা বিচ্ছিন্ন এক সম্প্রদায়ের খোঁজটাই বা রাখে ক’জন? মেথর, ঝাড়ুদার, ডোম নামের তথাকথিত নিচু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো যে বরাবরই সমাজের নাক উঁচু কুলীন শ্রেণির মানুষগুলোর কাছে চক্ষুশূল, দলিত এক জনগোষ্ঠীর নাম।

যাদেরকে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে সমাজের স্বাভাবিক পদচারণা থেকে শুরু করে তাদের শিক্ষার অধিকারটুকুও। এমনই এক সমাজের তথাকথিত ‘নিচু’ সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা লেখক- হরিশংকর জলদাস। জেলেপাড়ায় জন্মানো ও বড়ো হওয়া এই লেখক সচক্ষেই দেখেছেন মানুষে মানুষে প্রবল বৈষম্যের দগদগে ক্ষতগুলো। সেই দায়মুক্তি থেকেই হয়তো হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম, তাও ৫৫ বছর বয়সে। আর সেই পৌঢ়, শক্ত হাতে তিনি লিখেছেন অনবদ্য এক উপন্যাস, নাম তার রামগোলাম।

রামগোলাম এমন একটি উপন্যাস যাতে বারবার উঠে এসেছে হরিজনদের দুঃখ, দুর্দশার কথা। উঠে এসেছে তাদের মুক্তির পথের গল্প। স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প। বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতার গল্প! এছাড়াও হরিশংকর জলদাস তার আগের অন্যান্য উপন্যাসে লিখেছেন জেলেপাড়ার জেলেদের ও পতিতাদের বিষণ্ণ জীবন নিয়ে। ৫৫ বছর বয়সে কলম ধরা এ লেখক সমাজের দলিত শ্রেণির মানুষগুলোকে নিয়ে লেখালিখি করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

⏩ আরও পড়ুন: পদ্মা নদীর মাঝি : পাঠ প্রতিক্রিয়া!

রিভিউ

‘রামগোলাম’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একটি সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ বালক রামগোলাম। উপন্যাসটিতে হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন সুলেখক হরিশংকর জলদাস। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা মেথরপট্টির হরিজনদের জীবনযুদ্ধ নিয়ে লেখা আস্ত এই উপন্যাসে বারবার স্থান পেয়েছে সেসব হরিজনদের কথা যাদের পূর্বপুরুষদের সূদুর ভারত থেকে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে আসা হয়েছিল এই বাংলায়, তাও কি-না শুধুমাত্র টাট্টিখানা আর আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে লাগানোর জন্য!

লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে কীভাবে চট্টগ্রাম শহরের চারটি মেথর কলোনীর মধ্যেই আটকে গিয়েছিল এসব হতভাগ্য মানুষ ও তাদের উত্তরসূরীদের জীবন। রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিম্নশ্রেণির নাগরিক হয়ে যারা দিনযাপন করে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। যাদের জীবন কাটে এসব কলোনীর ছোটো ছোটো এক রুমের কামরায়। যেখানে পিতা, পুত্রের একই ঘরে সংসার পাততে হয়। দুর্বিষহ দাম্পত্য জীবনে যেখানে আড়ালের অবকাশ নেই, নেই কোনো গোপনীয়তা। যে পল্লীতে পিতার যৌন কার্যের শব্দ শুনতে পায় পুত্র, পুত্রবধু আর পুত্রেরটা পিতা। একটি ঘরে যে খাটিয়াটি রয়েছে, তাতে স্থান হয় নবদম্পতির। তারপর তারা যখন বৃদ্ধ হয়, তাদের পুত্রসন্তান যখন বিয়ে করে তখন তারা সেই নবদম্পতিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় আশ্রয় নেয়। এভাবেই একটি চক্রে বাঁধা পড়ে মানুষগুলোর জীবন।

এই হরিজনপল্লীর আবার একজন সর্দারও রয়েছে। যাকে হরিজন পাড়ার অন্যান্যরা সম্মান দেয়। হরিজনদের বিভিন্ন সমস্যার কথা যিনি তুলে ধরেন, বিভিন্ন বিচার শালিসে যাকে প্রধান হিসেবে মানা হয়। এইরকম একজন হরিজন সর্দার গুরুচরণের ঘরেই জন্ম নেয় একটি শিশু। শিশুটি সম্পর্কে গুরুচরণের নাতি। অর্থ্যাৎ তার ছেলের সন্তান। সর্দার গুরুচরণ হিন্দু-মুসলিম নাম মিশিয়ে তার নাতির নাম রাখেন রামগোলাম।

তার এই নামের একটি বিশেষত্ব রয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই নিজের এই অদ্ভুত নামটি নিয়ে অভিযোগ ছিল রামগোলামের। রামগোলাম? এটি আবার কেমন নাম! তবে আপাতদৃষ্টিতে বিশালদেহী, গোফওয়ালা ও প্রচণ্ড রাগী দাদুর কাছে এই প্রশ্নটি করবার সাহস হয়ে উঠছিল না ছোট্ট রামগোলামের! তবে একদিন খুব সাহস করে সে জিজ্ঞেস করেই ফেলে তার অদ্ভুত এই নামের রহস্য কী?

আর তাতেই সে জানতে পারে কীভাবে এই সমাজে তাদের সবচেয়ে নিচু স্থানে জায়গা দেওয়া হয়েছে। সমাজে হিন্দু বা মুসলিম সবাই তাদের ঘৃণা করে। হিন্দুদের রাম আর মুসলিমদের ফারসি ভাষা হতে আগত গোলাম শব্দটি নিয়ে আদরের নাতির নাম রাখেন রামগোলাম। সমস্ত জাত-পাত আর ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে নামের মতনই তার নাতি যেন একদিন সবার মাঝে বড়ো হয়ে উঠতে পারে।

⏩ আরও পড়ুন: পুতুলনাচের ইতিকথা : বই রিভিউ!

এই হরিজনপল্লীর পরবর্তী সর্দার হয়ে উঠেছিলেন রামগোলাম। যে হরিজনদের অধিকার আদায়ে নিজের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করতে চায়নি। কিন্তু হরিজনদের উন্নতি কি আর সমাজের নাক উঁচু কুলীনদের সহ্য হবে? বন্ধুবেশী শত্রুই কি শেষতক কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে রামগোলামের স্বপ্নের পথে?

জানতে হলে পড়তে হবে এই উপন্যাসটি। প্রিয় পাঠক, হরিশংকর জলদাসের ভুবনে আপনাকে স্বাগত! তাহলে দেরি কেন? আজই শুরু করুন না!

এক নজরে: রামগোলাম

উপন্যাস: রামগোলাম
জনরা: সামাজিক উপন্যাস
লেখক: হরিশংকর জলদাস
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ ৳
প্রকাশনী: প্রথমা প্রকাশন
ব্যক্তিগত রেটিং: ৩.৫/৫

ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

3 thoughts on “রামগোলাম : হরিজন সম্প্রদায়ের এক অনবদ্য উপাখ্যান!”

  1. বইটা পড়েছি, নতুনদের মধ্যে উনি বেশ ভালো লিখছেন

  2. অনেক ভালো বই। পড়েছি। হরিশংকর জলদাস মানেই ভিন্ন কিছু।

মন্তব্য করুন:

Scroll to Top