পৃথিবীর ইতিহাস জুড়ে আমরা অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির আবির্ভাব দেখতে পাই, তারা সমাজের প্রচলিত বাধাগুলি ভাঙতে পেরেছেন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছেন। হাইপেশিয়া ঠিক এমনই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। তিনি একজন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং দৃষ্টিশক্তির অধিকারী মহিলা ছিলেন, যিনি ইতিহাসের প্রথম মহিলা গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত। হাইপেশিয়ার অবদান শুধুমাত্র গণিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সামাজিক রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো এই মহিলা, শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পথ প্রশস্ত করে গিয়েছেন। আর এই কারণেই তাকে বরণ করে নিতে হয়েছিল করুণ মৃত্যু। এই নিবন্ধটিতে হাইপেশিয়ার জীবন, কৃতিত্ব এবং তার করুণ মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করব আমরা।
হাইপেশিয়া : পৃথিবীর প্রথম মহিলা গণিতবিদ ও তার নির্মম মৃত্যু
জন্ম
হাইপেশিয়ার জন্ম ঠিক কত সালে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন তিনি ৩৫৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। আবার অনেকে মনে করেন তার জন্ম ৩৭০ খ্রিস্টাব্দ, কারণ ৪১৫ সালে তার নির্মম মৃত্যুর সময়েও তিনি যথেষ্ট কম বয়সী ও সুন্দরী ছিলেন বলে জানা যায়। তবে অধিকাংশ জায়গায়ই তার জন্মসাল ৩৫৫ খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় শহরটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার ভুবনবিখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী থিওনের কন্যা। থিওনকে আলেকজান্দ্রিয়ার রত্ন হিসেবে বলা হতো। তিনি জ্ঞান গরিমা ও প্রতিভায় ছিলেন অতুলনীয়। তিনি একই সাথে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ও আলেকজান্দ্রিয়া জাদুঘরের প্রধান পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও, তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত রাজকীয় লাইব্রেরির প্রধান ছিলেন। বিখ্যাত এই লাইব্রেরিটি সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো লাইব্রেরি ছিল। তবে আজ আর সেই লাইব্রেরির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে তা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। এরপর হাইপেশিয়ার সাথে সাথে বিলীন হয়ে গেছে।
জ্ঞানার্জন
এমন যোগ্য পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাইপেশিয়া। সেই যুগে মহিলাদের জ্ঞানার্জনের কোনো সুযোগ ছিল না। তবে বুদ্ধিমান থিওন বুঝেছিলেন জ্ঞানার্জনের জন্য নারী পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জ্ঞানার্জন ছাড়া মানুষের জীবন অন্ধকার। তাই কন্যা হাইপেশিয়াকে তিনি নিজেই গণিত, দর্শন এবং বিজ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছিলেন, যা সেই যুগে মহিলাদের জন্য ছিল বিরল।
অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও মেধার অধিকারী হাইপেশিয়া খুব সহজেই একের পর এক গণিতের কঠিন – দুরূহ বিষয় আয়ত্ব করে নিচ্ছিলেন। ছোটো থেকেই তার মধ্যে ছিল জ্ঞানার্জনের প্রবল আগ্রহ। তাই পিতাও তাকে নিজের সবটা পাণ্ডিত্য উজার করে দিয়েছিলেন। এই হাইপেশিয়াই বড়ো হয়ে পাণ্ডিত্যে নিজের বাবাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
বিশেষ করে গণিতে হাইপেশিয়ার ব্যতিক্রমী প্রতিভা দ্রুত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বীজগণিত, সংখ্যা তত্ত্ব এবং জ্যামিতি সহ বিস্তৃত গাণিতিক শাখাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বীজগণিতে হাইপেশিয়া জটিল সমীকরণগুলি সমাধান করার পাশাপাশি, এর গণনাকে সরল করার জন্য অন্যান্য পদ্ধতিগুলি তৈরি করেছিলেন। সংখ্যা তত্ত্ব সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি মৌলিক সংখ্যা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য বোঝার অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে।
⏩ আরও পড়ুন: সেরাদের সেরা হতে চাইলে যে গুণগুলো থাকা জরুরি!
গণিতে তার দক্ষতা ও অবদান
হাইপেশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল জ্যামিতির ক্ষেত্রে। তিনি বিখ্যাত গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিডের কাজকে প্রসারিত ও পরিমার্জিত করেছিলেন। হাইপেশিয়া জ্যামিতির ওপর বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন, বিকল্প প্রমাণ প্রদান করেছেন এবং বিদ্যমান উপপাদ্যগুলির ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
একজন উজ্জ্বল গণিতবিদ হিসাবে হাইপেশিয়ার খ্যাতি তার ব্যক্তিগত কৃতিত্বের বাইরেও প্রসারিত হয়। তিনি একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষিকা হিসেবে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সেসময়। তখনকার ছাত্ররা তার কাছ থেকে শেখার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ায় ভিড় করতেন। তার প্রভাব গণিতের বাইরেও প্রসারিত হয়েছিল। তিনি গণিতের বাইরেও দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং নীতিশাস্ত্রও শেখাতেন। হাইপেশিয়া তার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রচলিত মতবাদকে প্রশ্ন করতে এবং সামাজিক বাধাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহিত করতেন। শিক্ষা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার কথা বলতেন তিনি, তার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হয়ে ওঠেন।
হাইপেশিয়া প্রথমে গ্রিসের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও, পরবর্তীতে আমন্ত্রণ পেয়ে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। এরপর আমৃত্যু তিনি আলেকজান্দ্রিয়াতেই ছিলেন।
তিনি শুধুমাত্র যে গণিত, দর্শন কিংবা জ্যোর্তিবিদ্যার ওপর গবেষণা ও কাজ করেছেন তা কিন্তু নয়। এছাড়াও তিনি বিজ্ঞানের অন্যান্য অনেক শাখাতেই ভূমিকা রেখেছেন।
হাইপেশিয়া অ্যাস্ট্রোল্যাব (যে যন্ত্রের সাহায্যে গ্রহ, নক্ষত্রের ঘূর্ণন নির্ণয় করা যেত) এবং হাইড্রোস্কোপ (যেটির মাধ্যমে তরল পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব পরিমাপ করা যেত) দুটি যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন।
যদিও হাইপেশিয়া তার অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভার জন্য প্রশংসিত ছিলেন এবং সম্মান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তার সাফল্য কিছু মহল থেকে শত্রুতা এবং ঈর্ষারও জন্ম দিয়েছিল। ফলে প্রথাভাঙা এই প্রতিভাবান নারী তৎকালীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তেজনার শিকার হয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
করুণ মৃত্যুবরণ
ইতিহাসে আমরা এমন বহু নারীর করুণ মৃত্যু দেখতে পাই, যাদের ডাইনি হিসেবে অভিযোগ করে তৎকালীন ধর্মীয় নেতারা দাউ দাউ আগুনে পুড়িয়ে মা’রত। নারীদের দমিয়ে রাখতে, তাদের পায়ে শিকল পড়াতে যুগে যুগে এরকম নানারকম সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা সৃষ্টি করেছেন তারা। এরকম দাউ দাউ আগুনে পুড়িয়েই মা’রা হয়েছিল জোয়ান অব আর্ক, ইতিহাসের আরেক শক্তিমান নারীকে।
৪১৫ খ্রিস্টাব্দে ঠিক এভাবেই হাইপেশিয়ার জীবন দুঃখজনকভাবে নিভিয়ে দেওয়া হয়। অসহিষ্ণুতা এবং কুসংস্কার দ্বারা চালিত ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের একটি দল তাকে ডাইনি বলে অভিযোগ এনে নির্মম’ভাবে হ’ত্যা করেছিল। হাইপেশিয়া সেদিন আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় তার ঘোড়ার গাড়িতে করে একা বের হয়েছিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই উগ্র সন্ত্রাসীর দল তাকে ঘিরে ধরে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনে। ঝিনুকের ধারালো খোলশ দিয়ে হাইপেশিয়ার চামড়া ও মাংস ছিঁ’ড়ে নিতে থাকে তারা। র’ক্তে ভেসে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার মাটি। এরপর তার দেহকে খন্ড-বিখন্ড করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই শেষ হয়ে যায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর পর মানুষ দীর্ঘকাল বিজ্ঞান শিক্ষায় অন্ধকারে ডুবে ছিল। সেই অন্ধকার কাটতে বহু বছর সময় লেগেছিল।
**********
পরিশেষে বলা যায়, পৃথিবীর প্রথম মহিলা গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত হাইপেশিয়ার অসাধারণ যাত্রা একজন নারীর সমাজের সকল প্রথা ভেঙে বুদ্ধি ও শক্তির প্রমাণ হিসাবে সগৌরবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। গণিতে তার অবদান এবং নারী স্বাধীনতার প্রতি তার অটল প্রতিশ্রুতি আজও মানুষদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। হাইপেশিয়ার জীবনী আমাদের একটি শক্তিশালী বার্তা দেয় যে, লিঙ্গ পরিচয় কখনোই একজন মানুষের স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হওয়া উচিত নয়।