দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, নির্মমতা ও জাপানের হিরোসিমা-নাগাসাকির সেই ভয়াবহ অ্যাটোমিক বোমা হামলা সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। ভয়াল সেই যুদ্ধ বদলে দিয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাস, রাজনীতি ছাড়াও কোটি কোটি মানুষের জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে নির্মিত হয়েছে বহু সিনেমা, গল্প ও গান। এই যুদ্ধে মিত্রশক্তির অন্যতম একটি দেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তি জয়লাভ করে। তাই হলিউডে এই যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সব সিনেমাই মহিমান্বিত করেছে কেবল বিজয়ীদের শোকগাঁথাই। দুঃখ কষ্টের সমস্ত চিত্র দেখানো হয়েছে কেবল বিজয়ী সৈনিকদের ও তাদের পরিবারের। কিন্তু মুদ্রার অপরপাশে পরাজিত জাতিরও রয়েছে ভয়াবহ নিপীড়ণের স্মৃতি। তাই তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরাজিত জাতির যুদ্ধের সেইসব ভয়াবহ স্মৃতি ও তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনাগুলো তুলে ধরতে জাপানের চিত্রপরিচালক ইসাও তাকাহাতা নির্মাণ করলেন অ্যানিমে সিনেমা ‘হোতারু নো হাকা’, যা ‘Grave of the Fireflies : গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস’ নামেই বেশি পরিচিত। এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, একঝাঁক মৃ’ত জোনাকির কবর। যুদ্ধের ভয়াল থাবায় নিহত হওয়া সেসব জোনাকিদের নিয়েই তৈরি একটি শক্তিশালী এবং হৃদয়বিদারক অ্যানিমে, গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস। এই সিনেমাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জাপানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সময় বেঁচে থাকার চেষ্টা করা দুই ভাই বোন সেইতা এবং সেতসুকোর গল্প। চলুন জানা যাক, এই অ্যানিমের ইতিবৃত্তান্ত।
Grave of the Fireflies
১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই অ্যানিমে সিনেমাটি স্টুডিও জিবলি দ্বারা প্রযোজিত হয়েছিল। জাপানি ঔপন্যাসিক ও গীতিকার আকিয়ুকি নোসাকার ‘হোতারু নো হাকা’ নামক একটি আত্মজৈবনিক ছোটোগল্পের ওপর ভিত্তি করেই একই নামে সিনেমাটি নির্মিত করা হয়। আকিয়ুকির পালক বাবা যুদ্ধে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ও তার দুই বোন তার চোখের সামনে অপুষ্টিতে মারা যায়। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতারই মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় তার গল্পে। আর সেই গল্পেই নির্মিত সিনেমাটি মুক্তির পর থেকেই একটি ক্লাসিক হয়ে ওঠেছে।
⏩ আরও পড়ুন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : আগামী পৃথিবীর অবিচ্ছেদ্য অংশ!
সিনেমাটির সূচনা হয় একটি অতি বেদনাদায়ক দৃশ্যের মাধ্যমে। একটি উক্তি শোনা যায়, ‘২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫। এই রাতেই আমি মা’রা যাই’ সাথে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি কিশোর বালকের একটি রেল স্টেশনে শেষ নি’শ্বাস ত্যাগের দৃশ্য। বালকটির নাম সেইতা। ব্যস্ত রেল যাত্রীরা বালকের মৃ’তদেহ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে নির্লিপ্তভাবে। যুদ্ধের সময়ে এখানে সেখানে মানুষ মরে পড়ে থাকা খুব স্বাভাবিক দৃশ্যই ছিল তখন। যে যেভাবে পারছে নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। এই সময় রেল স্টেশনের সাফাইকর্মীটি মৃ’ত বালকের কাছে আসে এবং তার সাথে একটি টিনের ছোটো কৌটো পায়। যেটি সে পাশের জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর সেখান থেকেই ছোটো একটি ফুলের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায় সেতসুকো নামের ছোট্ট একটি মেয়ে, মৃ’ত। আর তার পাশে এসে দাঁড়ায় সদ্য মৃ’ত তার ভাই সেইতার আত্মা। আর তাদের চারপাশে অসংখ্য জোনাকি পোকা, তারাও মৃ’ত। মৃ’ত্যু’র পরে ভাইবোনের মিলনের সেই অপার্থিব বিষাদময় দৃশ্য দেখে যে কারও চোখে জল আসবে।
তারা দুজন মিলে একটি শান্ত ট্রেনের কামড়ায় চড়ে বসে এবং সেখান থেকেই ফ্ল্যাশব্যাকে আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিনগুলিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, যেখানে দেখা যায় জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হচ্ছে। সেইতা এবং তার ছোটো বোন সেতসুকো যেই শহরে বাস করতো সেই কোবে শহরে যুদ্ধবিমানের বোমা হামলায় খুব খারাপ পরিস্থিতিতে দেখা যায়। সারা শহর জুড়ে বৃষ্টির মতন বোমা হামলায় ভীত ছোটো শিশু সেতসুকো কেঁদে ওঠে।
সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারার মতন ছুটে চলেছে। চোখের সামনেই নিজের প্রিয় বাড়ি ও চারপাশ আগুনে ছাড়খাড় হতে দেখে সেইতা ও সেতসুকো দ্রুত সেই স্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই বোমা হামলায় তাদের মা নিহত হলে তারা তাদের খালার কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যাই হোক, তারা খুব শীঘ্রই আবিষ্কার করে যে তাদের খালা তাদের পছন্দ করছে না এবং তাদের প্রতি অপমানজনক ও নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে। বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা তাদের কাছে বোঝার মতন।
⏩ আরও পড়ুন: পানির উপকারিতা ও অপকারিতা!
সাদা চোখে দেখলে সিনেমায় একমাত্র খলনায়িকার চরিত্রে তার সেই খালাটিকেই রাখা যায়। কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায় যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশে সবাই তখন অসহায়। মূলত যুদ্ধই এসব সাধারণ নিরীহ মানুষদের জীবনে বিছিয়েছে দুঃখের চাদর। সেইতা সেতসুকোর মতন এমন লাখ লাখ যুদ্ধবিদ্ধস্ত সাধারণ জাপানিরা ধুকে ধুকে ম’রছিল। যাই হোক, এরপর তারা ভাইবোন মিলে তাদের খালার বাড়ি ত্যাগ করে একটি পরিত্যক্ত বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার এবং নিজেরাই বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।
যত দিন যেতে থাকে, সেইতার তার ছোট্ট বোনের খাবারের জন্য এবং তাকে সুরক্ষিত রাখার লড়াই বাড়তে শুরু করে। সেতসুকো, যে এই যুদ্ধ পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার জন্য খুব কম বয়সী, সে প্রায়শই নির্দোষভাবে খাবার এবং খেলনার জন্য বায়না করত। যা কিশোর সেইতার হৃদয় ভে’ঙে দেয়; কারণ সে তার ছোটো বোনটির বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যটুকুই সরবরাহ করতে অক্ষম, সেখানে খেলনা তো বিলাসিতা।
তাদের এত কষ্ট সত্ত্বেও, ভাইবোনরা তাদের নিজেদের আনন্দ এবং কৌতুকপূর্ণ মুহূর্তগুলো খুঁজে নেয়। তারা জোনাকি ধরে এবং তাদের অন্ধকার আশ্রয়ে আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। তারা জঙ্গল ঘুরে ঘুরে বহু কষ্টে খাবার যোগার করে ও খায়। এভাবে সে ও তার বোন অপুষ্টিতে ভুগে মৃত্যুর দিকে আস্তে আস্তে পৌঁছাতে থাকে। এবং তাদের পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠলে, সেইতা তার বোনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
“Grave of the Fireflies” এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিকগুলির মধ্যে একটি হলো এটি যুদ্ধের সরাসরি বিস্তারিত তেমন দৃশ্য না দেখিয়েও, যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ দেখাতে সক্ষম। চলচ্চিত্রটি যুদ্ধের কঠোর বাস্তবতাকে চিত্রিত করেছে ও সাধারণ মানুষের যুদ্ধের জন্য কী কী ত্যাগ করতে হয় সেই কষ্টকে নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
একই সাথে চলচ্চিত্রটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত পরিবার এবং ভাইবোনের ভালোবাসাকেও ফুটিয়ে তুলেছে। সেইতার তার বোনের প্রতি ভালোবাসা এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মরিয়া সব প্রচেষ্টা দেখে চোখে জল আসেনি এমন কোনো মানুষ নেই।
⏩ আরও পড়ুন: মানবদেহে বাস করা ভয়ঙ্কর কিছু পরজীবী!
অ্যানিমেশন শব্দটি শুনলেই অনেকের মাথায় আসে বাচ্চাদের কার্টুনের কথা। কিন্তু জাপানি অ্যানিমেগুলো চিরাচরিত অ্যানিমে থেকে অনেকটাই ভিন্ন। Grave of the Fireflies – এই অ্যানিমেশনটি অত্যাশ্চর্যভাবে বোমা বিধ্বস্ত শহর এবং বিধ্বস্ত ল্যান্ডস্কেপের নিখুঁত এবং বিশদ বর্ণনা দিয়েছে। অ্যানিমেশনে বিশদ বিবরণগুলি খুবই নিখুঁত, চরিত্রগুলোর পোশাকের ছোটো ছোটো বিবরণ থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলির বৃহত্তর ল্যান্ডস্কেপ পর্যন্ত। সাথে চলচ্চিত্রে যুক্ত মিউজিকটি গল্পের আবেগঘণ আবহে অন্য মাত্রা যোগ করেছে, যেটি পুরোপুরি ফিল্মের মর্মান্তিক টোনকে ক্যাপচার করতে সক্ষম। সিনেমাটির পরিচালক তাকাহাতা নিজেও যুদ্ধপরিস্থির স্বীকার হয়েছিলেন, তাই হয়তো তিনি এটিকে এতটা নিখুঁত ও হৃদয়বিদারকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
যদিও ছবিটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুঃখজনক, তবে এটি মানুষের মানসিক শক্তিমত্তার একটি উদাহরণও বটে। সেইতা এবং সেতসুকোকে এখানে অকল্পনীয় কষ্টের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, তাদের জীবনের ছোটো ছোটো আনন্দ এবং আশার মুহূর্ত খুঁজে নিতে দেখা যায়, যা অপ্রতিরোধ্য প্রতিকূলতার মধ্যেও মানব চেতনার শক্তি এবং সাহসের প্রতিফলন।
উপসংহারে, “Grave of the Fireflies” একটি শক্তিশালী এবং মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র যা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধের বিধ্বংসী নির্মমতাকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। সিনেমাটি যেকোনো মানুষের ওপরই মানসিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম, তাকে যুদ্ধের নির্মমতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে ভাবাতে সক্ষম।
প্রিয় পাঠক, এই ছিল— Grave of the Fireflies : অ্যানিমে সম্পর্কে বিস্তারিত! আজকের পোস্ট এই পর্যন্ত। পোস্টটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা থাকলে কমেন্ট করুন। এই ধরনের পোস্ট আরও পড়তে ডেইলি লাইভ সাইটে নিয়মিত চোখ রাখুন।
সিনেমাটা দেখে কান্না করেনি এমন মানুষ নেই বোধহয়
আমার দেখা প্রথম অ্যানিমে। এতো মন খারাপ হয়েছিল দেখার পর!
বেশ সুন্দর রিভিউ।
আমি এখনো কান্না করছি😥😥😥