গোদ রোগ : উপসর্গ, কারণ, রোগ নির্ণয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ!

গোদ রোগ : উপসর্গ, কারণ, রোগ নির্ণয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ!

কয়েক বছর পূর্বে, ভারতের ভাগলপুরে বসবাসকারী সুনিতা কুমারী নামের একজন নারীর পায়ে হঠাৎ সমস্যা দেখা দেয়। প্রচণ্ড ব্যথাসহ তাঁর পা অনেক ফুলে যায়। ওই এলাকার মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাসী হওয়ায় সুনিতার পরিবারের সদস্যরা এবং স্বজনরা তাকে সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করার আদেশ দেয়। এমনকি তার শাশুড়িও তার বাচ্চাদের দূরে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে বাচ্চদের খারাপ কিছু হতে পারে। এরপর সুনিতা হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা জানান, তার একটি অসুখ হয়েছে। যার নাম ‘লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস’ বা ‘এলিফ্যান্টিয়াসিস’ বা বাংলায় গোদ রোগ। তো প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা এই গোদ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। চলুন শুরু করা যাক—

গোদ রোগ : উপসর্গ, কারণ, রোগ নির্ণয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ

গোদ রোগ কী?

গোদ রোগ বা ফাইলেরিয়াসিস হলো এক ধরনের কৃমিঘটিত রোগ। যা মূলত ফাইলেরিওয়ডিয়া পরিবারভুক্ত নিমাটোড জাতের গোলকৃমি (ফাইলেরিয়া) নামক পরজীবীর সংক্রমণে হয়। যারা মানুষের লসিকাগ্রন্থিতে অবস্থান করে লসিকা প্রবাহে বাধা দেয়। ফলে, আক্রান্ত স্থানে লসিক জমে জমে অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়। যাকে গোদ রোগ বলা যায়।

গোদ রোগ কীভাবে ছড়ায়?

ফাইলেরিয়া গোলকৃমি হলো এক ধরনের সূতার মতো দেখতে কৃমি। যাদের জীবন চক্র ৫ টি ধাপে গঠিত হয়। আক্রান্ত মানবদেহের মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী ফাইলেরিয়ার মিলনের ফলে হাজার হাজার মাইক্রোফাইলেরিয়ার জন্ম নেয়। আর যখন আক্রান্ত মানুষকে কোনো মশা (বাহক) কামড়ায়, তখন রক্তের মাধ্যমে মশার পেটে লার্ভা হিসেবে স্থান নেয়। পরে যখন বাহক মশা পুনরায় সুস্থ মানুষের রক্ত পান করতে যায়, তখন ওই সুস্থ মানুষের শরীরে গোলকৃমির লার্ভা প্রবেশ করে। এরপর প্রায় এক বছর পর লার্ভাগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হয়। আর মানুষের শরীরে গোলকৃমি প্রবেশের পর প্রাপ্তবয়স্ক হলে তখন এই কৃমিগুলো বিভিন্ন লসিকাগ্রন্থিতে অবস্থান নেয়। আর লসিকাগ্রন্থি আমাদের শরীরের একটি বিশেষ অঙ্গ যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। এই লসিকাগ্রন্থিগুলো আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করে। যার ফলে, ফাইলেরিয়া গোলকৃমির আক্রমণের পর আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। গোলকৃমি যখন লসিকা নালী ও গ্রন্থিতে বাসা বাঁধে, তখন আমাদের লসিকা প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। যার জন্য আমাদের শরীরের আক্রান্ত অংশে লসিকে জমে জমে ফুলে যায়। আর এটাই হলো মূলত— গোদ রোগ। এই গোলকৃমির লার্ভাগুলো মানুষের রক্তে ভেসে চলে। বলা হয়ে থাকে, গোদ রোগ একটি মশাবাহিত রোগও বটে। অ্যাডিস এবং ম্যানসোনিয়া প্রজাতির মশার মাধ্যমে এশিয়ায় এই গোদ রোগটি সাধারণত ছড়ায়। আর বাংলাদেশে এটি কিউলেক্স প্রজাতির স্ত্রী মশা দ্বারা ছড়ায়।

⏩ আরও পড়ুন: মানবদেহে বাস করা ভয়ঙ্কর কিছু পরজীবী!

গোদ রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ কী কী?

কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোদ রোগের প্রাথমিকভাবে লক্ষণ দেখা যায়। তবে, হাত, পা, স্তন, জননাঙ্গ, পুরুষের অন্ডকোষ ইত্যাদি ফুলে যাওয়া হলো এই রোগের সাধারণ লক্ষণ। অনেক রোগীদের মধ্যে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় পায়ে এই রোগ বেশি হয়ে থাকে। ফোলা ও বড়ো হয়ে যাওয়ার কারণে আক্রান্ত স্থানে অনেক ব্যথাসহ পা নড়াচড়া করা যায় না।

গোদ রোগ হলে এর বাইরে ত্বকেও অনেক রকমের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন—

১. ত্বকে শুষ্কতা বেড়ে যায়।
২. ত্বকে বিভিন্ন ক্ষত বা ঘা এর আবির্ভাব ঘটে।
৩. ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় কালচে ভাব দেখা দেয়।
৪. ত্বকের পুরুত্ব বেড়ে যাওয়াসহ ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।

এছাড়াও কারও কারও ক্ষেত্রে এই জীবাণু প্রবেশ করলে জ্বর আসতে পারে। আর এই রোগ দ্বারা যেকোনো বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারে।

উল্লেখ্য, মানবদেহে প্রবেশের পর গোদ রোগের জীবাণু অনেক দিন পর্যন্ত নিজেকে লুকিয়ে রাখকে পারে। পূর্ণাঙ্গ একটি জীবাণু ৫-৭বছর পর্যন্ত বাঁচে। যেসব রোগী ছোটো বেলায় এই রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের সাধারণত হাত-পা ফুলে যায়। পরে চিকিৎসার অভাব বা ঘাটতি হলে বড়ো হতে হতে হাত বা পা পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে।

গোদ রোগ হলে আক্রান্ত স্থানের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে একে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: লিম্ফোঅ্যাডেমা, হাইড্রসেলি এবং অ্যাকিউট অ্যাটাক

যেহেতু আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে গোদ রোগ ধ্বংস করতে পারে; এর কারণে গোদ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির এই রোগের পাশাপাশি অন্য রোগও হতে পারে। যাকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন বলা হয়। এই রকম একটি রোগ হচ্ছে— ট্রপিক্যাল পালমোনারি ইওসিনোফিলিয়া সিনড্রোম। আমাদের শরীরে যখন শ্বেত রক্ত কণিকা ইওসিনোফিলের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন সেই অবস্থাকে বলা হয়— ইওসিনোফিলিস। এই রোগের ফলে, বুকে ব্যথা দেখা দেয়, প্লীহা বড়ো হয়ে পড়ে, রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা, কফ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

গোদ রোগ কীভাবে নির্ণয় করা হয়?

গোদ রোগ আসলেই হয়েছে কিনা, এটা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। যেমন— রক্ত পরীক্ষা, লিম্ফ নোড পরীক্ষা, এক্স-রে, আলট্রাসাউন্ড, ইত্যাদি।

কাদের গোদ রোগ হবার ঝুঁকি রয়েছে?

গোদ রোগকে Neglected tropical diseases (NTD) সারিতে এই রোগকে ফেলা হয়। NDT নামক রোগগুলো সাধারণত আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঘটে। যেসব দেশে পরিষ্কার পানির স্বল্পতা থাকে বা মানুষের বর্জ্য নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা থাকে না, সেসব স্থানে NDT এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

এখন অবধি বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২ কোটি রোগী আছে, যারা গোদ রোগে আক্রান্ত। এছাড়াও ৭২টি দেশে এই গোদ রোগের রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। মূলত, যেসব দেশগুলোতে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি সেগুলো হলো: আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান।

এছাড়া গোদ রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি রয়েছে যাদের—

  • দীর্ঘ দিন ধরে ট্রপিক্যাল বা সাব-ট্রপিক্যাল এলাকায় বসবাসবাসকারী।
  • আক্রান্ত রোগীর আশে পাশে থাকা মশার কামড় খেলে।
  • অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘদিন বসবাস করলে।

⏩ আরও পড়ুন: মশাবাহিত ছয়টি ভয়ংকর রোগ!

গোদ রোগ প্রতিরোধের উপায় কী কী?

  • যেসব এলাকায় গোদ রোগের রোগী রয়েছে, এমন জায়গা ভ্রমণ করতে চাইলে অবশ্যই মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে হবে, ফুলহাতা কাপড় পরিধান করতে হবে, পুরো পা ঢেকে যায় এমন ট্রাউজার পরিধান করতে হবে, সু বা ক্যাডস জুতো পরতে হবে, এছাড়াও শরীরের খোলা স্থানে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত মশারোধী ওষুধ / ক্রিম ব্যবহার করতে হবে।
  • নিজে এবং পরিবারের সবাইকে গোদ রোগ থেকে দূরে রাখতে অবশ্যই বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় কয়েকদিন পর পর কেটে ফেলুন, বাড়িঘর নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখুন, খাল-ডোবা-ড্রেন ময়লা পরিষ্কার রাখুন এবং নিয়মিত বাড়ির আঙিনায় মশা মারার ওষুধ ছিটান।

গোদ রোগের চিকিৎসা কী?

গোদ রোগ একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। তাই, শরীরে রোগ ধরা পড়া মাত্র বা সন্দেহজনক মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। তবে, এর বাইরেও কিছু নিয়মকানুন আছে যেগুলো মেনে চলা অনাবশ্যক । যেমন—

  • আক্রান্ত স্থান সাবানপানি দিয়ে যত্ন সহকারে ধুয়ে পরিষ্কার করা এবং শুকনো রাখা।
  • দিনে এবং রাতে ফুলে যাওয়া হাত কিংবা পা ওপরের দিকে উঠাতে হবে যেন ফোলা জায়গায় জমে যাওয়া তরল চলাচল করতে পারে।
  • এছাড়াও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শরীরে তরল চলাচল বাড়ানোর জন্য ব্যায়াম করতে হবে। কারণ, ব্যায়াম লসিকাগ্রন্থির উন্নতি ঘটাতে পারে।
  • ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষতস্থানে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বা অ্যান্টি-ফাংগাল ক্রিম লাগাতে হবে।
  • আক্রান্ত পায়ে যাতে আঘাত না পায় এর জন্য পরিমিত সাইজের জুতো পরতে হবে।
  • এছাড়াও রোগীর অবস্থা গুরুতর হলে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। আক্রান্ত স্থানের অবস্থা বেশি খারাপ হলে রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি করানো হয় অথবা শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে আক্রান্ত লসিকাগ্রন্থিকে তুলে ফেলা হয়।

গোদ রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশের কোথায় পাবেন?

বাংলাদেশে ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগের চিকিৎসার জন্য একটি বিশেষ হাসপাতাল রয়েছে। এটি সমগ্র বিশ্বের প্রথম হাসপাতাল, যা শুধুমাত্র এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত। জাপানের সহায়তায় সৈয়দপুরে হাসপাতালটি করা হয়। পরে অবশ্য ২০১২ সালে সাভারে আরেকটি হাসপাতাল চালু করা হয় একই ধরনের। এই হাসপাতালগুলোতে গোদ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রচুর শয্যা এবং উন্নত সরঞ্জাম রয়েছে। পাশাপাশি এই রোগ সম্পর্কে আরও জানতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করা হচ্ছে। ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল দুইটির নাম হলো:

১. ফাইলেরিয়া হাসপাতাল (সৈয়দপুর, নীলফামারী)
২. ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল (সাভার, ঢাকা)

**********

প্রিয় পাঠক, ওপরে আমরা সুনিতা কুমারীর কথা বলেছি। কিন্তু, কেবল ভারতে নয়, এমন ঘটনা বাংলাদেশেও প্রায়শই ঘটে। এই গোদ রোগটিকে এখনো অনেকে স্রষ্টার অভিশাপ ভাবে। তাই এই সম্পর্কে মানুষ কথা বলতে পছন্দ করে না। বরং এই গোদ রোগ সামাজিক ট্যাবু হিসেবেই আছে। ইতোমধ্যে এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায়, যেমন— নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রাজশাহী, এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ এ দেখা যায়।

তাই, সুনিতা কুমারীর মতো এই রোগের রোগীকে হেলাফেলা না করে আপনার আশেপাশে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন। এক্ষেত্রে, আপনার যদি ডেইলি লাইভের এই আর্টিকেলটি ভালো লাগে, তবে এটি আপনার পরিচিতদের শেয়ার করতে পারেন। যা হতে পারে সচেতনতা প্রথম ধাপ। নিজে জানুন এবং অন্যকে জানান। যাতে এই সুনিতার মতো কাউকে সামাজিকভাবে হেয় হতে না হয় এবং পাশাপাশি এই রোগ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দিয়ে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও আপনার যেকোনো প্রশ্ন কিংবা মতামত জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে।

যাই হোক, আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। নিজে ভালো থাকুন এবং অন্যকে ভালো রাখুন। ডেইলি লাইভ এর পাশে থাকুন।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

1 thought on “গোদ রোগ : উপসর্গ, কারণ, রোগ নির্ণয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ!”

  1. গোদ রোগ সম্পর্কে আগে জানতাম না। লেখাটা পড়ে অনেক ডিটেইলস জানতাম। ধন্যবাদ ডেইলি লাইভে এমন তথ্যবহুল আর্টিকেলের জন্য।

মন্তব্য করুন:

Scroll to Top