আজ দুপুরে “বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র” নামক ফেসবুক গ্রুপে এএনএম শফিকুল আলম নামের জনৈক ব্যক্তি একটি পোস্ট দেন। পোস্টে তিনি শতবর্ষী পুরোনো একটি চিঠির ছবি যুক্ত করে জানান, এই চিঠিটি তাঁর দাদি তাঁর দাদাকে লিখেছিলেন। অর্থাৎ, এটি একজন বাঙালি রমণীর শতবর্ষী পুরোনো চিঠি! চিঠিটির তারিখ থেকে জানা যায়, চিঠিটি প্রায় ১০২ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২২ সালে লেখা হয়েছে। জনাব, শফিকুল আলমের পোস্টটি আমরা শুরুতে হুবুহু তুলে ধরছি—
“আজ থেকে ১০১/১০২ বছর আগে আমার দাদাকে লিখা দাদীর চিঠি। আমার দাদী অভিমান করে তার বাবার বাড়িতে যায়। আমার বাবার বয়স তখন আড়াই বছর। অনেক মান/অভিমান ও পারিবারিক কিছু কথা আছে। স্বামীকে সম্বোধন ও ভাষার স্টাইল দেখার মতো। চাউল ভেজে পুড়ে যাওয়ার পর সেটা ডাস্ট করে জাম গাছের বাকল বা ছালের রস মিকচার করে তৈরি করা কালি। লিখেছেন ময়ুরের পাখার কলম দিয়ে।” [সোর্স: ফেসবুক পোস্ট]
পোস্ট করার পরপরই চিঠিটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এই পর্যন্ত ফেসবুকে উনার পোস্টটিতে আড়াই হাজারের মতো রিঅ্যাকশন, ১৫০+ কমেন্টস এসেছে এবং পোস্টটি শেয়ার হয়েছে ১৫০ বারেরও বেশি।
অ্যান্টিক কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্যালু থাকায় অনেকেই চিঠিটি পছন্দ করছেন। কিন্তু সাধু ভাষায় রচিত এবং টানা টানা অক্ষরে ময়ূরের পাখনা দিয়ে লেখা হওয়ার কারণে অনেকে চিঠিটির মূল লেখাগুলো পাঠোদ্ধার করতে পারছেন না। ফলে, তারা চিঠিটি পাঠোদ্ধার করে পড়ার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। বিষয়টি খেয়াল করে, আমাদের ডেইলি লাইভ সম্পাদনা টিম দীর্ঘক্ষণ সময় ব্যয় করে, চিঠিটির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করে, অবশেষে সম্পূর্ণ চিঠিটির টেক্সট ভার্সন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই ভার্সন মূল চিঠির ছবিসহ আপনাদের কাছে তুলে ধরা হলো।
বাঙালি রমণীর শতবর্ষী পুরোনো চিঠি
ছবি ০১:
১৩২৯ |
১৬ ই অগ্রহায়ণ
প্রাণাধিকা প্রাণেশ্বর,
সেলাম কোটি কোটি পর সমাচার এই যে- আজ কয়েক দিন গত হইল আপনার একখানা তিরের ন্যায় লিপিকা আসিয়া আমার কলেজায় চোট লাগাইয়াছে। আমার শরির কাতর থাকায় উক্ত পত্র খানার যথা সময়ে উত্তর দিতে পারি নাই। ৫-৬ দিন যাবত জ্বরে ভুগিয়া গত কল্য ভাত পথ্য করিয়াছি। আমাকে যদি খোদা একটু আরোগ্য করিয়াছে, আবার শ্রীমানের জ্বর গত রাত্রে আসিয়াছে আজ এ পর্য্যন্ত জ্বর ছাড়ে নাই। যাহাই হউক খোদা ভরসা খোদাতালার পায়ে বাকিটাকে ছাড়িয়া দিয়েছি। তিনি যাহাই করেন তাহাই – কবুল!
স্বামিন আপনার পত্রের উত্তর লেখিতে লেখনি চলে না কলেজা বিদির্ন হইয়া গিয়াছে। দেখুন আমি আপনাকে আপছারের মায়ের গোলাম লেখি নাই লেখিয়াছি অধিন। কিন্তু তাহার অধিন কে নয়, বাসায় যে মজিদ আছে ও আপনার পিতা সকলেই তাহার অধিনস্ত। আর এও একটা কথা আপনি স্বামি আমি স্ত্রি। আপনি আমার উপর রাগ হইলে মনের রাগে যাহা ইচ্ছা তাহাই বলিতে পারেন আমারও মন আপনার উপর রাহ হইলে কিছুই বলিতে পারি। স্বামির সহিত স্ত্রির জোর স্ত্রির সহিত স্বামির জোর ইহা সংসারের রীতি। কিন্তু ঐ কথাটুক লেখিয়াছি মনের অনেক দুঃখ ছিল বলিয়া।
⏩ আরও পড়ুন: হাইপেশিয়া : পৃথিবীর প্রথম মহিলা গণিতবিদ ও তার নির্মম মৃত্যু!
ছবি ০২:
২।
ঐ আপছারের মা আমাকে কত বকিয়াছেন আপনাকে জানাইয়াছি মাকে যাহা ইচ্ছা তাহাই বলিয়াছেন তাহাও আপনাকে জানাইয়াছি এবং মছিরনও অনেকদিন অনেক কথা আপনাকে জানাইয়াছে তবু আপনি তাহার একটি উত্তর করেন নাই। আমাদের হইয়া না বলেন মায়ের পক্ষ থাকিয়া একটি কথা বলিতেন তবুত দুঃখের কিছু লাঘব হইত:
আর আমরা যে মাতায় কন্যাই য্যতিশ গণনার দ্বারা ধরিয়াছি এবং ঐ সব কুৎসা সকলেই মিলে সর্বদা আন্দলন করিয়া থাকি। হায় খোয়া আমরা যদি ওসব কোন কিছু উল্লেখ করিয়া কি আমার মাতা যদি কোন কুঘোষণা করিয়া থাকেন তাহা তুমি বিচার করিবেন। আহা স্বামিন আমার মাতার মিথ্যা কথ্যটি লেখিয়াছেন এই দুঃখে হৃদয় বিদির্ন হইয়া যাইতেছে। মা আপনাকে পুত্র সমতুল্য জানেন। আপনার কত ভাল মন্দ কথা কোনদিন পিতাকে বলেন না সে সমন্দে খোদাতালার ঘরে দাড়াইয়া এবং কোরান শরিপ হাতে লইয়া কিরা করিয়া বলিতে পারি। হায় আপনি না বুঝিয়া না শুনিয়া মিথ্যা অপবাদ মাকে দিয়াছেন, খোদাতালা কি ইহার বিচার করিবেন না। আমি স্ত্রি আমাকে যেন দোষারোপ করিতে পারেন। যাহাই হউক, মাকে যাইতে আপনি লেখিলেন না কেন মা গেলে আপনার তহবিল ক্ষতি হয়। ১ বৎসর দেড় বৎসরে আপনার তহবিল কত ক্ষতি হইয়াছে।
ছবি ০৩:
৩।
তাহা সামান্য পত্রে লিখা বাহুল্য তাহাকে মাসঅন্তে ১ জোড়া করিয়া কাপড় দেওয়া হইয়াছিল এবং শ্বাশুরী সমাদরে কত খাওয়া হইয়াছিল কাজেই আপনার তহবিল ক্ষতি।
স্বামিন ইচ্ছা ছিল আপনি বাবাকে লিখিলে মা যাইবেন আমিও যাইব। ছেলেটার শীতে কষ্ট পাইতে হইত না, কিন্তু কোথায় বাবাকে মাকে যাইবার পত্র লিখিবেন আপনার পত্র খানা পড়িয়াই কলেজা ফাটিয়া যাইতেছে। আপনি মুক্ত কণ্ঠে লিখিয়াছেন তোমার পিতাকে কেন আমি, তোমার মাকে আনার জন্য লিখিব। খোদা করেন আগামি বুধবার অবশ্ব পৌঁছিতাম কিন্তু এখন দেখি মা ত আপনার হস্তলিখিত পত্র না পাইলে যাইবেন না। অপর অন্য কেহ নাই যে লইয়া যাইব আমার শরিরটাও ভাল নাই কে আমাদের তত্ত্বাবধান করিবে।
এ অবস্থায় যাইয়া কি করি, কাজ করিয়া খাইতে না পারিলে ভাত দিবে কে। এবং আগুনে শীতে ছেলেটার তত্ত্বাবধান করিবে কে। স্বামিন শ্বাশুরী নাই যে ত চতুর্দিকে দেখিবে। আপছারের মার কুবাক্য শুনিতে যাইয়া কি করি?
দেখি উক্ত তারিখে যদি যাওয়া হয় তবে বাসায় অবন্ত উঠিয়া যাইব। তবে আমার পুনঃ অনুরোধ অতিসত্বর একখানা পত্র বাবাকে লিখেবেন। হাতে হাতে পত্র পাঠাইলে অতিসত্বর পাওয়া যায়, ডাকে দিবার দরকার কি কেবল পয়সার খরচ। হাতে ২ দিনে সেই দিবসেই পাওয়া যায় বিলম্ব নাই। আমার এলাকার আনারটী আমার পরিচিত আমাদের আত্মিয়ের মধ্যে।
ইতি আপনার *****
পাঠোদ্ধার: আবুল হাসনাত বাঁধন (সম্পাদক)
**********
প্রিয় পাঠক, এই ছিল সেই— বাঙালি রমণীর শতবর্ষী পুরোনো চিঠির পাঠোদ্ধার কিংবা বর্তমান টেক্সট ভার্সন। উল্লেখ্য, আমরা আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সঠিকভাবে টেক্সট ভার্সন তৈরির। তারপরও দুয়েকটা অনাকাঙ্খিত ভুল থেকে যেতে পারে, এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এছাড়া চিঠিতে বেশ কিছু বানান ভুল এবং তৎকালীন প্রচলিত বানান রয়েছে, আমরা চিঠি লেখকের সম্মানার্থে উনার লেখা বানানই রেখেছি। যেমন: উনি স্বামী, স্ত্রী বানানে ‘ই’ ব্যবহার করে স্বামি – স্ত্রি লিখেছেন, আমরা সেটাই লিখেছি।
আর চিঠিটির শুরুতে তারিখ লেখা আছে, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ। আর আজকে হলো— ১২ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে হিসেব করে দেখেছি, চিঠিটি লেখার ইংরেজি তারিখ ছিল— ১ ডিসেম্বর, ১৯২২। এই হিসেবে চিঠিটির বয়স এখন ১০১ বছর ৩ মাস ২৬ দিন কিংবা ৩৭০০৭ দিন। এতদিন, এতবছর পুরোনো একটা চিঠি পারিবারিক কালেকশনে থেকে গেছে। চিঠিটা নিঃসন্দেহে জাদুঘরে থাকার মতো!
এছাড়া সেই যুগে মেয়েদের পড়ালেখার প্রচলন খুব একটা ছিল না। এমন সময়ের, একজন নারীর লেখা এমন কাব্যিক শব্দচয়নযুক্ত চিঠি আমাদের চিন্তার জগতে আঘাত করে। তিনি যে স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত ছিলেন, তাঁর প্রমাণ স্বরূপ চিঠিটা কালের সাক্ষী হয়ে থেকে গেল…।